নিম অ্যান্টিভাইরাল, রোগ প্রতিরোধ বাড়ায়, আলসার থেকে হার্টের রোগ নিরাময়, জানুন নিমের হাজারো গুণ

বিশ্বজুড়েই নিমের কদর। নিম গাছ, শিকড়, নিম ফল, গাছের ছাল ওষুধের দরকারি কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অ্যান্টিসেপটিক, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিভাইরাল, অ্যান্টিফাঙ্গাল গুণ আছে নিমের।

সঞ্জীব আচার্য

কর্ণধার সিরাম অ্যানালিসিস

ত্বক থেকে চুল, সর্দিকাশি থেকে হজমের সমস্যা, ডায়াবেটিস থেকে হার্টের রোগ—যে কোনও সমস্যার সহজ সমাধান আছে নিমে। দৈনন্দিন জীবনের খুচরো রোগ থেকে জটিল অসুখ সারাতে নিমের গুণাগুনের তারিফ করেন চিকিৎসকরাও। ভারতীয় আয়ুর্বেদে নিমের বহুগুণের কথাই বলা হয়েছে। নিমের পাতা, ডাল, নিমের রস সবেরই কোনও কিছুই ফেলার নয়।

বিশ্বজুড়েই নিমের কদর। নিম গাছ, শিকড়, নিম ফল, গাছের ছাল ওষুধের দরকারি কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অ্যান্টিসেপটিক, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিভাইরাল, অ্যান্টিফাঙ্গাল গুণ আছে নিমের। ম্যালেরিয়া নিরাময় করতে পারে আবার দাঁতের চিকিৎসাতেও ব্যবহৃত হয়।

বহুগুণে গুণী নিম

প্রায় চার হাজার বছরের বেশি ভারতীয় আয়ুর্বেদে নিমের ব্যবহার হয়ে আসছে। নিমপাতার গুণে মুগ্ধ পশ্চিমী দুনিয়াও। নিম পাতার রস কৃমিনাশক, হজমের সমস্যা দূর করে, আলসার কমায়। কার্ডিওভাস্কুলার রোগের থেরাপিতেও নিমের ব্যবহার আছে। জ্বর কমাতে, ডায়াবেটিস নিয়্ন্ত্রণে, লিভারের সমস্যা দূর করতে নিম অতুলনীয়।

নিমের ছালে আছে ইমিউনোমড্যুলেটরি পলিস্যাকারাইড, শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করে পারে। পেটের সমস্যা, ইন্টেস্টিনাল আলসার কমাতে এবং ত্বকের যে কোনও সংক্রমণজনিত রোগ কমাতে নিমের ছালের ব্যবহার হয়।

নিমে ফুল পিত্তনাশ করে। কৃমিনাশক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

নিম তেলে আছে ট্রাইগ্লিসারাইড, ট্রাইটারপিনয়েড ও কীটনাশক অ্যাজাডিরাকটিন যৌগ। যে কোনও প্রদাহজনিত রোগ কমাতে নিম তেল ব্যবহার করা হয়। গর্ভনিরোধক হিসেবেও নিমতেল ব্যবহার করা হয়।

নিম গাছের শিকড় থেকে ভেষজ ওষুধ তৈরি হয়।

নিমের যেমন জীবাণুনাশক ক্ষমতা আছে, তেমনই এর অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট শরীরের টক্সিনকে দূর করে তাকে সুস্থ-সবল রাখে। নিম পাতা বেটে লাগালে যেমন ত্বকের প্রদাহজনিত রোগ দূর হয়, তেমনই নিম পাতা খেলেও অনেক অসুখ সারে।

এবার দেখে নেওয়া যাক নিমে কাবু হয় যে যে রোগ—

দাঁতের ক্ষয় কমায়

নিম অ্যান্টিবায়োটিক। টুথপেস্ট ও মাউথওয়াশের উপাদান হিসেবে ব্যহৃত হয়। নামী ব্র্যান্ডের টুথপেস্টেও নিমকে প্রধান উপাদান হিসাবে ব্যবহার করে অনেক সংস্থাই। নিম পাতার রস দাঁত ও মাড়ির ব্যথা কমিয়ে দিতে পারে, দাঁতের ক্ষয় রোগ কমায়। মাড়ি থেকে রক্ত পড়া বন্ধ করে। বুকে কফ জমলে নিম পাতা বেটে এর রস সামান্য গরম জলে মিশিয়ে দিনে তিন থেকে চারবার খেলে উপকার পাওয়া যায়।

আলসার কমায়

পেটের সমস্যা দূর করতে নিমের জুড়ি নেই। নিম হজমে সাহায্য করে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, আলসার কমাতে ৩০-৬০ মিলিগ্রাম নিম ছালের রস দিনে দু’বার করে দশ সপ্তাহ খেলে উপকার পাওয়া যায়।


সোরিয়াসিস কমাতে

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ত্বকের সংক্রমণজনিত রোগ সোরিয়াসিস কমাতে পারে নিম। নিম পাতার নির্যাস ১২ সপ্তাহ ধরে খেয়ে গেলে উপকার মেলে। তার সঙ্গে স্যালিসাইলিক অ্যাসিড ক্রিমের প্রয়োগও দরকার। তাছাড়া ত্বকের চুলকানি, অ্যালার্জি বা যে কোনও সংক্রমণজনিত রোগ কমাতে নিমের ব্যবহার হয় ভেষজ চিকিৎসায়।

রক্তে শর্করা কমায়

নিম পাতার রস রক্তে শর্করার পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে। রক্তনালীকে প্রসারিত করে, শরীরে রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়। নিম পাতা ও গোলমরিচ একসঙ্গে বেটে খেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে।

চুল ভাল রাখে

নিমের জীবাণুনাশক গুণ খুশকি দূর করে সহজেই। শুকনো স্কাল্পের সমস্যায় খুব উপকারী নিম। আবহাওয়া বদলের সঙ্গে স্কাল্পের পিএইচ-এর ভারসাম্য হেরফের হয়। ফলে চুল কখনও তৈলাক্ত হয়, আবার কখনও শুষ্ক। সঙ্গে বাড়ে খুশকির সমস্যা। এই সমস্যা দূর করতে নিম পাতার নির্যাস ব্যবহার করার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।


ওজন কমায়

নিম ফুলের রস ওজন কমাতে সাহায্য করে। নিম ফুল বিপাকের হারও বাড়ায়। নিম ফুল গুঁড়ো করে তার সঙ্গে এক চামচ মধু ও আধ চামচ লেবুর রস মিশিয়ে খেলে মেদ ঝরে সহজেই।

রক্ত পরিষ্কার করে

নিমের অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট ক্ষমতা প্রচুর। শরীরের টক্সিন দূর করে রক্তকে শুদ্ধ রাখতে বিশেষ উপকারী নিম। এ জন্যই রোজকার খাবারের তালিকায় নিম রাখলে উপকার পাওয়া যায়। নিম পাতা ভাজা বা নিম দিয়ে তেতো তরকারি খেতে পারলে খুব ভাল। নিমের রস সকালে খালি পেটে খেলেও উপকার মেলে।

জন্ডিস কমায়

বিশেষজ্ঞরা বলেন, জন্ডিস হলে সকালে নিম পাতার রস মধু মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়। ২৫ থেকে ৩০ ফোঁটা নিম পাতার রসের সঙ্গে মধু মেশাতে হবে। সপ্তাহখানেক খেলেই রোগ কমতে শুরু করবে।

নিম অ্যান্টিভাইরাল

আগেকার দিনে চিকেন পক্স, হাম বা চর্মরোগ হলে নিম পাতা বেটে লাগানোর রেওয়াজ ছিল। এখনও ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হলে নিমের রস লাগানো বা নিম জলে স্নান করতে বলেন বিশেষজ্ঞরা। নিমের অ্যান্টিভাইরাল গুণ আছে। নিমের রস খেলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ শক্তি বাড়ে।

কোন কোন ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে

নিম যেমন ভাল তেমনি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া এর অধিক ব্যবহারে খারাপ ফলও হতে পারে। যেমন—

নিম তেল শিশুদের জন্য খুব একটা ভাল নয়। বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া ব্যবহার করলে নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। পেটের রোগ, বমি, ঝিমুনি, মস্তিষ্কের রোগ হতে পারে।

প্রসূতি মহিলা এবং যে মায়েরা সন্তানকে বুকে দুধ খাওয়ান তাঁদের ক্ষেত্রে নিমের ছাল ও নিম তেল একেবারেই নিষিদ্ধ।

নিম ইমিউন সিস্টেমকে বেশিমাত্রায় অ্যাকটিভ করে দেয়। তাই অটো-ইমিউন রোগের ক্ষেত্রে যেমন মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে নিমের ব্যবহার খুব একটা চলে না।

অনেক সময় দেখা যায়, নিমের রসে রক্তে শর্করার পরিমাণ বেশিমাত্রায় কমে যায়। তাই ডায়াবেটিসের রোগীদের নিমের ব্যবহার করার আগে রক্ত পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া দরকার। বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়েই নিমের ব্যবহার করা উচিত।

সন্তান পরিকল্পনা করলে নিমের ব্যবহার বেশি না করাই ভাল। নিমের রস অত্যধিক শরীরে ঢুকলে শুক্রাণুর পরিমাণে প্রভাব পড়ে।

অঙ্গ প্রতিস্থাপনের সার্জারি হবে যাঁদের, তাঁদের ক্ষেত্রে নিম উপযোগী নয়। অর্গান ট্রান্সপ্লান্টে নানা সাইড এফেক্টস হতে পারে।