‘ম্যাজিক যৌগ’ হলুদের কারকিউমিন! জীবাণুনাশক, রোগ প্রতিরোধক, ক্যানসারেরও মোকাবিলা করে

কাঁচা ও শুকনো হলুদে প্রচুর পরিমাণ এই কারকিউমিন উপাদান থাকে। এমন এক যৌগ যা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। শরীরের তীব্র প্রদাহ, জ্বালাপোড়া কমাতে পারে।

সঞ্জীব আচার্য

কর্ণধার সিরাম অ্যানালিসিস

হলুদ ছাড়া রান্নার রাজকীয়তাই আসে না। রঙ হোক বা স্বাদ, এক চিমটে হলুদেই বাজিমাত। তবে বাঙালির পাতের কিছু পদে অবশ্য হলুদ না দিলেও চলে। সে কথা থাক। এই যে রান্নায় হলুদ দেওয়ার রেওয়াজ সেটা শুধু স্বাদ বা রঙের জন্যই নয়। হলুদের নানা ঔষধি গুণও রয়েছে। রান্না হোক বা ত্বকের পরিচর্চা, সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে হলুদকে সম্মানের আসনেই বসানো হয়েছে। ভারতীয় আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে সে জীবাণুনাশক, রোগ প্রতিরোধক। ভেষজ চিকিৎসায় তার গরিমা অস্বীকার করা যায় না।

এই হলুদ যে নানা কাজের কাজী, তার কারণ হল এর মূল রাসায়নিক উপাদান। কারকুমিনয়েড তথা কারকিউমিন। কাঁচা ও শুকনো হলুদে প্রচুর পরিমাণ এই কারকিউমিন উপাদান থাকে। এমন এক যৌগ যা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। শরীরের তীব্র প্রদাহ, জ্বালাপোড়া কমাতে পারে। অর্থাৎ অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান হিসেবেও এর সুনাম আছে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানও হলুদের বহুগুণকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

১৯১০ সালে প্রথম হলুদের এই রাসায়নিক উপাদান কারকিউমিনকে চিহ্নিত করেন বিজ্ঞানীরা। ওষুধ তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয় এই উপাদান। আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞরা কারকিউমিনকে ম্যাজিক যৌগ বলেন। যদিও কারকিউমিনের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও আছে। গর্ভবতী মহিলাদের জন্য কারকিউমিন উপযোগী নয়।

এখন দেখে নেওয়া যাক মানুষের শরীরে কারকিউমিনের ভূমিকা ঠিক কী কী—

তীব্র প্রদাহ প্রতিরোধী

বিশেষজ্ঞরা বলেন কারকিউমিন হল প্রাকৃতিক অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি কম্পাউন্ড। যে কোনও সংক্রমণজনিত ক্ষত, প্রদাহ সারাতে পারে এই যৌগ। ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা প্যাথোজেন শরীরে ঢুকলে যে তীব্র প্রদাহজনিত রোগ তৈরি হয় তাকে নির্মূল করতে কারকিউমিনের জুরি মেলা ভার। বিশেষত সাইটোকাইন প্রোটিনের ক্ষরণ বেশি হলে এই ধরনের প্রদাহ তৈরি হয়। বিজ্ঞানীরা বলেন, ক্রনিক ইনফ্ল্যামেশন যদি হয় সেক্ষেত্রেও কারকিউমিন উপযোগী। এনএফ-কেবি (NF-KB) উপাদান যা কোষে প্রদাহ তৈরি করে, তার ক্রিয়া বন্ধ করতে পারে কারকিউমিন।

প্রাকৃতিক অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট

শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে বিশেষ ভূমিকা আছে কারকিউমিনের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিড সংক্রমণ রুখতেও কার্যকর হতে পারে হলুদের এই উপাদান। শরীরে পিত্ত নিঃসরণ বাড়ায় কারকিউমিন, হজম শক্তি বাড়ায়। খাদ্যনালীর যে কোনও সংক্রমণ ঠেকাতে পারে। বদহজম, আলসারেটিভ কোলাইটিস, ক্রনিক পেটের রোগ সারাতে পারে কারকিউমিন।

ব্যথা-নাশক
পেশীর ব্যথা, গাঁটে গাঁটে ব্যথা কমাতেও বিশেষ ভূমিকা আছে হলুদের এই রাসায়নিক উপাদানের। অস্টিও আর্থ্রাইটিস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস সহ জয়েন্ট পেন কমাতে সাহায্য করে।

হার্ট ভাল রাখে

হার্টের রোগের ঝুঁকি কমায় কারকিউমিন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এন্ডোথেলিয়ম কোষের কার্যকারিতা বাড়ায়। এই এন্ডোথেলিয়াম রক্তের চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে, রক্ত চলাচলে সাহায্য করে। এর কার্যক্ষমতা বিগড়ে গেলে রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করে। হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এই ঝুঁকি কমায় কারকিউমিন। পাশাপাশি হৃদপিণ্ডের রক্তবাহী ধমনীতে চর্বি জমতে দেয় না। কোনওভাবে ধমনীতে ফ্যাট জমতে থাকলে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যায়। হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। এই ঝুঁকি কমায় কারকিউমিন।

মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ায়, অ্যালঝাইমার্সের ঝুঁকি কমায়

ব্রেন হরমোন বিডিএনএফ (BDNF)-এর ক্ষরণ বাড়ায় কারকিউমিন। এই হরমোন নতুন নিউরন তৈরি করতে সাহায্য করে। ফলে মস্তিষ্কের যে কোনও জটিল রোগ হওয়ার সম্ভাবনা কমে। স্মৃতিশক্তি উন্নত হয়। স্মৃতিনাশের ঝুঁকি কমে। মস্তিষ্কের কোষ সক্রিয় থাকে, বয়স বাড়লে ডিমেনশিয়া বা অ্যালঝাইমার্সে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা অনেকটাই কমে যায়। পাশাপাশি, মানসিক অবসাদও কমায় কারকিউমিন।

ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে

ক্যানসার কোষের বাড়বাড়ন্ত থামিয়ে দিতে পারে হলুদের কারকিউমিন। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, নিয়মিত হলুদ ব্যবহার করলে প্রি-ক্যানসারযুক্ত পলিপ ৬০ শতাংশেরও বেশি কমে যায়। একই সঙ্গে শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা বাড়ে। এই শ্বেত রক্ত কণিকাই শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে তুলতে পারে। শ্বেত রক্ত কণিকা থেকেই তৈরি হয় অ্যান্টিবডি যা সংক্রামক প্যাথোজেনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, কারকিউমিনের হাই ডোজ ক্যানসার আক্রান্ত কোষগুলির মোকাবিলা করতে পারে। বিশেষ করে কলোরেকটাল ক্যানসার প্রতিরোধে কারকিউমিনের বিশেষ ভূমিকা আছে। গবেষকরা বলছেন, পরীক্ষা করে দেখা গেছে কোলন ক্যানসার রয়েছে এমন রোগীকে টানা ৩০ দিন ধরে দিনে ৪ গ্রাম করে কারকিউমিন খাওয়ানোর ফলে সংক্রমণ প্রায় ৪০% কমে গেছে।