১.২ কেজির টিউমার বেরোল পাঁজরের চারটি হাড় কেটে! কলকাতায় বেনজির সাফল্য

তিয়াষ মুখোপাধ্যায়

বয়স মাত্র ২১। দক্ষিণ ২৪ পরগনার কঙ্কনদিঘির বাসিন্দা, সুন্দরবনের তরতাজা যুবক। হঠাৎই একদিন বাঁ দিকের পাঁজরে ফোলা ভাব দেখে, প্রথমে তেমন গুরুত্ব দেয়নি কেউই। কিন্তু ধীরে ধীরে ফোলা বাড়লে, তার সঙ্গে ব্যথাও শুরু হলে, ডাক্তার দেখানো হয় তাঁকে। কিছুদিন চিকিৎসাও চলে স্থানীয় ভাবে। কিন্তু তাতে উপকার দূরের কথা, ক্রমেই যেন ফুলে উঠতে থাকে পাঁজর। যেন একটি মাংসপিণ্ড বাড়ছে শরীরের ভিতরে। সেটা ছিল ২০১৮ সাল।

এর পরে চিকিৎসকের পরামর্শে হারাধন পুরকায়েত নামের ওই যুবককে বেঙ্গালুরু নিয়ে যায় পরিবার। সবরকম পরীক্ষা করে ধরা পড়ে, মারাত্মক অসুখ। পাঁজরের ভেতরে বাড়ছে একটি ম্যালিগন্যান্ট মাংসপিণ্ড। ডাক্তারি পরিভাষায় এর নাম এউইং সারকোমা

টিউমার সঙ্গে নিয়ে, বহু পথ ঘুরে শেষমেশ অ্যাপোলো হাসপাতাল অসাধ্য সাধন করল তিন বছর পরে। পাঁজরের খাঁচা কেটে, অস্ত্রোপচার করে বার করে আনল ১.২ কেজি ওজনের ঘাতক টিউমারটি! সার্জিক্যাল অঙ্কোলজিস্ট ডক্টর শুভদীপ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে, কয়েক জন চিকিৎসকের একটি দল কার্যত মিরাক্যাল ঘটালেন।সারকোমা কী?

একধরনের বিরল ম্যালিগন্যান্ট টিউমার বলা যেতে পারে একে। সারা বিশ্বে ১ শতাংশ শিশুর এই অসুখ দেখা যায়। ভারতে যত রকম ক্যানসার দেখা যায়, তার ০.২ শতাংশ হল এই সারকোমা। সাধারণত খুব বেশি হলে ১৫ বছর পর্যন্ত এই অসুখ হয়। তবে এক্ষেত্রে সুন্দরবনের হারাধনের প্রথম উপসর্গ দেখা দেয় ২১ বছর বয়সে, যা বলতে গেলে একরকম বিরল ঘটনা।এটি মূলত শরীরের বিভিন্ন অংশের হাড়, মাংসপেশি, নার্ভ, রক্তনালী ইত্যাদি স্থান থেকে উৎপত্তি হয়। সারকোমার প্রধান দুটি ধরন হল, বোন সারকোমা বা অস্টিওসারকোমা এবং সফট টিস্যু সারকোমা। এক্ষেত্রে অস্টিওসারকোমার শিকার হয়েছিলেন হারাধন। তাঁর পাঁজরের হাড়ে বাসা বেঁধে ছিল এই ভয়ানক টিউমার।শুরুতে শুধু ব্যথাবিহীন চাকা বা দলা নিয়ে এটা প্রকাশ পায়। হারাধনের ক্ষেত্রেও প্রথমে শুধু ফোলাভাবই দেখা গিয়েছিল। সেই ফোলাটি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন আশপাশের মাংসপেশি বা নার্ভকে চাপ দেয়, তখনই অস্বস্তি বা ব্যথার সৃষ্টি হয়। তাই লক্ষণ প্রকাশ না পাওয়া পর্যন্ত একে শনাক্ত করা কঠিন। ঠিক যে কারণে দেরি হয়েছিল হারাধনেরও। অনেকটা বড় হয়ে গেছিল টিউমারের আকার।

অসুখ ধরা পড়ার পরে মাথায় কার্যত আকাশ ভেঙে পড়েছিল পরিবারের। একমাত্র সন্তানের এই কঠিন অসুখের কথা শুনে পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেছিল। প্রাথমিক ভাবে ক্যানসারের চিকিৎসা হিসেবে শুরু হয় কেমোথেরাপি। আট দফায় কেমোথেরাপি চলে। এর পরে কলকাতায় এনে হারাধনকে ভর্তি করা হয় পিজি-তে। কিন্তু টিউমারের কোনও উন্নতি হয়নি।শেষমেশ রোগীর পরিবার দ্বারস্থ হন অ্যাপোলো হাসপাতালের। অ্যাপোলো ক্যানসার সেন্টারের মেডিক্যাল অঙ্কোলজি বিভাগের ডিরেক্টর পিএন মহাপাত্রর সঙ্গে যোগাযোগ করেন তাঁরা। তিনিই এই বিশেষ কেসটি রেফার করেন সার্জিক্যাল অঙ্কোলজিস্ট ডক্টর শুভদীপ চক্রবর্তীর কাছে। ডাক্তারবাবু সিদ্ধান্ত নেন, অস্ত্রোপচার করে বাদ দিতে হবে ঘাতক টিউমারটিকে। বলাই বাহুল্য, যথেষ্ট ঝুঁকির এ অস্ত্রোপচার। প্রাথমিক ভাবে সংশয়ে ছিল রোগীর পরিবার। তাঁরা নিশ্চয়তার জন্য অন্য হাসপাতালের সঙ্গেও পরামর্শ করেন কিন্তু অস্ত্রোপচারের ঝুঁকি নিতে চাননি কেউই।শেষমেশ ডক্টর শুভদীপ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে তৈরি হয় বিশেষ টিম। অ্যাসোসিয়েট সার্জিক্যাল অঙ্কোলজিস্ট ডক্টর তাপস কর সহায়তা করেন ডক্টর চক্রবর্তীকে।

অঙ্কোসার্জেন ডক্টর শুভদীপ চক্রবর্তী এবং প্লাস্টিক সার্জেন ডক্টর আদিশ বসু।

কনসালট্যান্ট প্লাস্টিক সার্জন ডক্টর আদিশ বসু অস্ত্রোপারের পরে ফের নতুন করে তৈরি করেন পাঁজর। অ্যাসোসিয়েট সিটিভিএস সার্জন হিসেবে ছিলেন ডক্টর  তমাশিস মুখোপাধ্যায়। ডক্টর তন্ময় দাস এবং ডক্টর কৌস্তুভ চক্রবর্তী ছিলেন এই অস্ত্রোপচারের অ্যানাস্থেসিওলজিস্ট।৫ অগস্ট ঠিক হয় অস্ত্রোপচারের তারিখ। ফুসফুস, হার্ট বা বড় কোনও শিরা-উপশিরার কোনও ক্ষতি না করে, চারটি পাঁজর কেটে, ১.২ কেজি ওজনের টিউমার বাদ দেন ডক্টর চক্রবর্তী। সেই সঙ্গে বাদ দেন চারটি ক্ষতিগ্রস্ত পাঁজরও। এর পরে বোন সিমেন্ট এবং প্রোলিনের মাধ্যমে কৃত্রিম ভাবে তৈরি করা সেই পাঁজর। নতুন পাঁজরটিকে আবার পিঠের দিক থেকে পেশি এনে তার সাহায্যে ঠিক জায়গায় বসানো হয়।এই গোটা পর্বটা চলে ৯ ঘণ্টা ধরে। কার্যত ম্যারাথন অস্ত্রোপচার চালান চিকিৎসকরা। এত বড় ও জটিল অস্ত্রোপচারে দরকার হয়নি কোনও রক্তেরও। সফল অস্ত্রোপচারের পরে, কয়েক দিন হাসপাতালে ছিলেন রোগী। অবশেষে আজ, শনিবার তাঁকে ছুটি দেওয়া হয়েছে। সুস্থ শরীরে বাড়ি ফিরেছেন যুবক।

হারাধনের বাবা বাসুদেব পুরকায়েত জানান, অ্যাপোলোর চিকিৎসকদের কাছে কৃতজ্ঞতার ভাষা নেই তাঁর। সন্তানের এত বড় অসুখে দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন। তার উপর অস্ত্রোপচার নিয়ে নানা রকম পরস্পরবিরোধী মতামত ছিল, ছিল ঝুঁকির আশঙ্কা। তবু তিনি অ্যাপোলোর চিকিৎসকদের উপরেই ভরসা করেছিলেন এবং এখন সুস্থ শরীরে ছেলেকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছেন।