জিভের একটা ছোট্ট আলসারও বিপদ ঘটাতে পারে, মুখ ও গলার ক্যানসারের লক্ষণ কী কী

গুড হেলথ ডেস্ক

ক্যানসার শুনলেই মৃত্যুভয় জেগে ওঠে রোগীর মনে। কিন্তু ডাক্তারবাবুরা বলছেন ক্যানসার মানেই সব শেষ নয়। যদি রোগের শণাক্তকরণ ও  চিকিৎসা সঠিক সময়ে হয় তাহলে ক্যানসার নিয়ন্ত্রণে রাখাও সম্ভব। এখনকার সময় মুখ ও গলার ক্যানসার (Head and Neck Cancer) নিয়ে চর্চা বেশি হচ্ছে। গুগলে এই নিয়ে বিস্তর খোঁজাখুঁজিও চলছে। অনেকেই মনে করেন মুখ ও গলার ক্যানসার মানে ব্রেন ক্যানসার। আদতে তা নয়। মুখ ও গলার ক্যানসার বলতে ঠিক কী বোঝায়, কীভাবে রোগ ধরা পড়বে এবং এর চিকিৎসাও বা কী, সেই নিয়ে বিস্তারিত বললেন কলকাতার অ্যাপোলো ক্যানসার সেন্টারের দু’জন অভিজ্ঞ সার্জিক্যাল অঙ্কোলজিস্ট ডা. শুভদীপ চক্রবর্তী ও ডা. তাপস কুমার কর।

মুখ ও গলার ক্যানসার (Head and Neck Cancer) কী? কোন কোন জায়গায় ক্যানসার হয়?

প্রথমেই জেনে নেওয়া দরকার, এই মুখ ও গলার ক্যানসার বলতে ঠিক কী বোঝায়, অর্থাৎ শরীরের কোথায় কোথায় ক্যানসার হলে তা এই ক্যাটেগরির আওতায় আসে। ডা. শুভদীপ চক্রবর্তী বললেন, মুখ ও গলার ক্যানসার হয় মূলত জিভ, তালু, ঠোঁট, গাল, মাড়ি, টনসিল, ল্যারিংস, থাইরয়েড গ্ল্যান্ড এইসব জায়গায়। মুখের ভেতরে ক্যানসার কোষ বাসা বাঁধে, ক্রমশ তা গলার দিকে নামে।

head and neck cancer

কারণ কী? তামাকই কি একমাত্র কারণ?

মুখ ও গলার ক্যানসারের জন্য অবশ্যই সিগারেট, গুটখা, তামাকজাতীয় জিনিস দায়ী। তবে সিগারেট খান না এমন ব্যক্তিরও মুখ ও গলার ক্যানসার হতে দেখা গেছে। এর জন্য নানা ফ্যাক্টর কাজ করে, যেমন–দাঁতের গঠন। অনেকেরই তীক্ষ্ণ দাঁত গালে ঘষা লেগে সেখানে ঘা হয়ে যায়। কোনও ট্রিটমেন্ট না করলে সেখান থেকে ক্যানসার ছড়াতে পারে। আবার কিছু ভাইরাল ইনফেকশন থেকেও ক্যানসার হতে পারে, যেমন এইচপিভি (হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস)।

সিগারেট খেলে শুধু ফুসফুসে ক্যানসার হয়। তা নয়। সিগারেট খেলে ওরাল ক্যানসার থেকে শুরু করে গলার ক্যানসার, চেস্টের ক্যানসার, প্যানক্রিয়াসের ক্যানসার এমনকি রেক্টাল ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে। তামাকজাত যে কোনও জিনিসই ওরাল ক্যানসারের কারণ হতে পারে।

Oral, Head and Neck Cancer

মুখ ও গলার ক্যানসার ধরা পড়লে বাঁচার সম্ভাবনা কতটা?

ডাক্তারবাবুরা বলছেন, অনেক রোগীই এই প্রশ্নটা করেন ক্যানসার ধরা পড়লে বাঁচার সম্ভাবনা কতটা। এটা নির্ভর করে কে কতটা সেনসিটিভ। ধরা যাক, কারও জিভে ক্যানসার ধরা পড়ল। জিভের একটা ছোট্ট জায়গায় হলে সেটা স্টেজ ওয়ান। এবার ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি হয়ে জিভ থেকে লিম্ফ নোডগুলিতে ছড়াল। সেটা স্টেজ টু। তৃতীয় স্টেজ (Head and Neck Cancer) মানে সব ক’টা লিম্ফ নোড আক্রান্ত। পরবর্তী পর্যায়ে স্টেজ ফোরে গিয়ে দেখা যাবে, প্রাথমিক স্টেজের সঙ্গে কোনও সম্পর্কই নেই। অর্থাৎ ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছে ফুসফুসে বা শরীরের অন্য জায়গায়।

এবার রোগীর এমন অবস্থায় সঠিকভাবে রোগের চিহ্নিতকরণ ও চিকিৎসা জরুরি (Head and Neck Cancer)। দেখা গেছে, স্টেজ ওয়ানে ক্যানসার ধরা পড়লে রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা ৯০-৯৫ শতাংশ, স্টেজ টু-তে হলে সেটাই হবে ৭০-৭৫ শতাংশের কাছাকাছি, তৃতীয় স্টেজে গিয়ে সেটা ৬০ শতাংশ হতে পারে। যদি এর মধ্যে ক্যানসার নিয়ন্ত্রণে না আনা যায় তাহরে স্টেজ ফোরে গিয়ে রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা থাকে ৪০ শতাংশ, কোনও ক্ষেত্রে সেটাই ২০ শতাংশ।

Head and Neck Cancer

শরীর কী কী সঙ্কেত দেয়?

এই ক্যানসারের বিভিন্ন স্টেজ থাকে। প্রথম স্টেজটা খুব লোকালাইজ়়ড। ধরুন মুখের ভেতরে জিভে আলসার হয়েছে। অনেকদিন ধরে সারছে না। মুখের ভেতরে আলসার থেকে রক্ত পড়ছে। যদি ওষুধ খেয়েও না সারে তখন সতর্ক হতে হবে। দেখবেন মুখের স্বাদ চলে যাচ্ছে, ঢোঁক গিলতে সমস্যা হচ্ছে। ছোট্ট আলসার বিপদের কারণ হতে পারে।

নির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসা আছে কি?

ক্যানসারের মাল্টি মডেল ট্রিটমেন্ট হয়। এক, সার্জিক্যাল বা অস্ত্রোপচার করে, দুই, রেডিয়েশন থেরাপি, তিন, মেডিক্যাল অঙ্কোলজি। আর স্টেজ ফোরে চলে গেছেন যে রোগীরা তাঁদের জন্য রয়েছে প্যালিয়েটিভ বা সাপোর্টিভ কেয়ার। এইসব কিছুর সংমিশ্রণেই ট্রিটমেন্ট হয়। যদি একটা পর্যায় ভুল হয়ে যায় তাহলে গোটা চিকিৎসা পদ্ধতিটাই বিগড়ে যেতে পারে। এর জন্য সুশৃঙ্খলভাবে মেডিক্যাল টিম নিয়ে এর ট্রিটমেন্ট করা দরকার। 

ক্যানসারের চিকিৎসা সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন দরকার ঠিকই তবে ব্যক্তিবিশেষে চিকিৎসার ধরন বদলে যায়। যেমন ইমিউনোথেরাপি সকলের জন্য প্রযোজ্য নয়। সেক্ষেত্রে রোগীর শারীরিক অবস্থা দেখে ট্রিটমেন্ট করা হয়। 

গুগলে অনেকেই খোঁজেন ‘ভাল গুটখা’ কিছু আছে কিনা

ডাক্তারবাবুরা বলছেন, তামাকজাত দ্রব্য কখনওই ভাল নয়। এর মধ্যে এমন ক্ষতিকর বস্তু আছে যা শরীরের ক্ষতি করে। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই বিজ্ঞাপনী চমকে ভুলে এটা ধরতে পারেন না। অজয় দেবগন, অক্ষয় কুমার যে গুটখা খাচ্ছেন তা খেলেও যে ক্যানসার হতে পারে সেটা আগে বোঝা দরকার।

তামাকজাত নেশার জিনিসের মধ্যে থাকে অ্যারাকালিন নামে এক ধরনের কার্সিনোজেন তা খুবই খারাপ প্রভাব ফেলে শরীরে। শুধু গুটখা নয়, দোক্তা, পানের সুপুরি, পানের মশলায় মিছরি ও অন্যান্য কিছু উপাদানেও এই ক্ষতিকর কার্সিনোজেন থাকতে পারে।

ই-সিগারেটে ক্ষতি কতটা?

ই-সিগারেটের ভেতরে থাকা তরল পদার্থ এবং ধোঁয়া এমন সব ক্ষতিকর রাসায়নিক বহন করতে পারে, যা সাধারণ সিগারেটের ভেতরেও থাকে। সিগারেটের বিপদ এড়িয়ে ধূম সেবনের সুখের আশায় ই-সিগারেট ধরেছেন অনেকেই। তাঁদের বিশ্বাস, ই-সিগারেট আখেরে ধূমপানের অভ্যাস ছাড়তে সাহায্য করে। তেমনটা দাবি করা হয় বিজ্ঞাপনেও। কিন্তু দেখা গেছে,  এর প্রভাব সাধারণ সিগারেটের চেয়েও ক্ষতিকর হতে পারে। ই-সিগারেটের তরল মিশ্রণ (ই-লিকুইড)-এ থাকে প্রপেলিন গ্লাইসল, গ্লিসারিন, পলিইথিলিন গ্লাইসল, কৃত্রিম গন্ধ এবং নিকোটিন। গরম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সব রাসায়নিক থেকে সাধারণ সিগারেটের ধোঁয়ার সমপরিমাণ ফরমালডিহাইড তৈরি হয় যা ক্ষতি করতে পারে। ই-সিগারেটের ধোঁয়ার রাসায়নিকও ক্ষতিকর।

হুকা বারগুলো বলছে তামাক দিচ্ছি না, এটা কি ঠিক?

সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকে নিকোটিন যা ফুসফুসের জন্য বিষ। হুকার ধোঁয়া তৈরি হচ্ছে চারকোল থেকে। এর সঙ্গেই মিশছে তামাক। দুয়ে মিলে বিষাক্ত টক্সিন ঢুকছে ফুসফুসে। ফলে শ্বাসনালী ও ফুসফুসের ক্ষতি অনেক বেশি হচ্ছে। কমবয়সীদেরই ভিড় বেশি হয় হুকা বারে। তাই কম বয়স থেকেই ক্যানসারের মতো মারণ রোগ ধরছে অনেকের।

মুখ ও গলার ক্যানসার মানেই কি মৃত্যুর পরোয়ানা?

হেড ও নেকের ক্যানসার মানেই মৃত্যু নয়। শুধু সঠিক সময়ে ট্রিটমেন্ট দরকার। অনেকেই দীর্ঘদিন নানা রকম চিকিৎসা করিয়ে অ্যাডভান্স স্টেজ নিয়ে আসেন। তখন রোগ সারানো জটিল হয়ে পড়ে। তাই উপসর্গ দেখে, বায়োপ্সি করে নিশ্চিত হয়ে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা দরকার।