
‘শেকেন বেবি সিনড্রোম’ জানেন কি, বাচ্চাদের এভাবে আদর করবেন না একদম, বলছেন ডাক্তারবাবুরা
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ছোট বাচ্চাদের কোলে নিয়ে আদরে গদগদ হন ক্ষতি নেই, কিন্তু ঝাঁকাঝাঁকি করাটা মোটেও ভাল কথা নয়। সদ্যোজাতদের তো একেবারেই নয়। অনেকে আবার ঘাড়ের নীচে হাত রেখে বাচ্চাদের ঝাঁকাতে থাকে নানাভাবে। একটু বড় বলে কোলে নিয়ে লোফালুফিও করে। ডাক্তারবাবুরা বলছেন, আদর করুন যত খুশি, কিন্তু কোনওভাবে যাতে মাথায় বেশি ঝাঁকুনি না লাগে সেটা খেয়াল রাখতে হবে। আদরের চোটে একবার যদি নরম মস্তিষ্কে চোট লাগে, তার প্রভাব হতে পারে মারাত্মক। মাথার ভেতরে রক্তক্ষরণ, চোখের দৃষ্টি ঝাপসা এবং বুদ্ধির বিকাশ থেমে যেতে পারে মাঝপথেই।
বেশি ঝাঁকুনিকে বাচ্চাদের মাথায় যদি গুরুতর চোট লাগে তাহলে মস্তিষ্ক বা ব্রেনে গিয়ে তার প্রভাবটা পড়ে। যার কারণে মস্তিষ্কের নানা জটিল রোগ হতে পারে। ডাক্তারি ভাষায় একে বলে ‘শেকেন বেবি সিনড্রোম’ (Shaken Baby Syndrome) । এই ধরনের সিনড্রোমের সঙ্গে অনেকেই পরিচিত নন। নামও অজানা বেশিরভাগের কাছেই। ডাক্তারবাবুরা তাই বলছেন, অসাবধানতাবশত ছোট্ট বাচ্চাদের মাথায় ও ঘাড়ে আঘাত লেগে যেতে পারে। অতিরিক্ত ঝাঁকুনি, কোলে নিয়ে বেশি দোল দিলেও এমনটা হতে পারে। আসলে বাচ্চাদের মাথার হাড় খুব নরম থাকে। কখন তাতে চোট লেগে যাচ্ছে, সেটা বাবা-মায়েরাও বুঝতে পারেন না। তাই সতর্ক থাকতে হবে সবসময়।
শেকেন বেবি সিন্ড্রোম কী?
শেকেন বেবি সিনড্রোম মস্তিষ্কের ক্ষত। ছোট বাচ্চাদের উপর-নীচে ঝাঁকালে, বা আদরের সময় হাতে নিয়ে লোফালুফি করলে অনেক সময়েই মাথায় ও ঘাড়ের নরম অংশে আঘাত লেগে যায়। আসলে বাচ্চারা কাঁদতে থাকলে কোলে নিয়ে তাদের ভোলান বাবা-মায়েরা। কান্না না থামলে অধৈর্য হয়ে জোরে জোরে দোল দিতে শুরু করেন। ভাবেন এতে বাচ্চা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বে, কান্নাও থামবে। ডাক্তারবাবুরা বলছেন, এই সময় ঘাড়ের নরম মাংসপেশিতে আঘাত লাগতে পারে। মাথার হাড়েও চোট পেতে পারে বাচ্চা। বাইরে থেকে এটা বোঝা যায় না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে মস্তিষ্কের ক্ষতি হতে থাকে। ক্ষত তৈরি হয়।
মাথার খুলির ভেতরে ব্রেন বা মস্তিষ্ক সেরিব্রো স্পাইনাল ফ্লুইড নামে একধরনের তরলে ভাসমান অবস্থায় থাকে। শিশুদের মস্তিষ্ক খুবই নরম হয় বলে অল্প ঝাঁকুনিতে হাড়ের সঙ্গে ঘষা খেয়ে চোট পেতে পারে। এতে মস্তিষ্কে ক্ষত তৈরি হয়। মাথার ভেতরে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। ক্ষতি হয় চোখের রেটিনারও। যে কারণে দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে যেতে পারে। মাথায় জল জমার মতো সমস্যা তৈরি হতে পারে।
ডাক্তারবাবুরা বলছেন, সদ্যোজাত শিশু ও দু’বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের এমন শেকেন বেবি সিন্ড্রোম হতে পারে। তবে পাঁচ বছরের শিশুর ক্ষেত্রেও এমন রোগ হতে দেখা গেছে। সেক্ষেত্রে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত বা শক্ত কিছুতে মাথা ঠুকে গেলে এমন হতে পারে। অনেক সময় অভিভাবকরা রেগে গিয়ে বাচ্চাদের মারধোর করেন। বেখেয়ালে ঘাড়ে, মাথায় লেগে যেতে পারে। তখনও এমন রোগ দেখা দেয়। তাই বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাচ্চাদের শাসন করার সময়েও সতর্ক থাকতে হবে অভিভাবকদের। মাথা ঠুকে দেওয়া বা মাথায় মারলে তার প্রভাব হতে পারে সাঙ্ঘাতিক। মাথা ও ঘাড়ে যাতে কোনওভাবেই আঘাত না লাগে সেটা সবসময় খেয়াল করতে হবে।
কী কী লক্ষণ দেখে সতর্ক হবেন
শেকেন বেবি সিন্ড্রোম বাইরে থেকে বোঝা যায় না অনেকসময়েই। মাথার ভেতরে রক্তক্ষরণ হতে থাকলে তার অনেকগুলো লক্ষণ দেখা যায়। বাবা-মায়েদের এই উপসর্গগুলো দেখে সতর্ক হতে হবে।
বাচ্চা দীর্ঘসময় না ঘুমোলে, ক্রমাগত কাঁদতে থাকলে সতর্ক হতে হবে। এই ধরনের রোগ হলে ঘুমই চলে যাবে।
খিঁচুনি, কাঁপুনি এই ধরনের উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
খিদে কমে যাবে, বাচ্চা খেতে চাইবে না একদম। কিছু খেলেই বমি হয়ে যাবে।
গায়ের রঙে বদল আসবে। চামড়া ফ্যাকাশে হয়ে যেতে পারে। মাথায় ক্ষত বেশি হলে অনেক সময়েই শরীর নীল হতে শুরু করে।
হাতে, বুকে ব্যথা হতে পারে। শ্বাস নিতে সমস্যা হতে পারে শিশুর।
মাথায় ফোলাভাব দেখা যায় অনেকসময়। কপাল ফুলে যেতে পারে বাচ্চাদের।
মাথা তুলতে সমস্যা হবে। মাথা ভারী লাগবে, ব্যথা করবে।
মাথার ভেতর যদি রক্তক্ষরণ বেড়ে যায়, তাহলে বাচ্চা অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। পরিস্থিতি জটিল হলে কোমায় চলে যেতে পারে।
কীভাবে বোঝা যাবে বাচ্চার শেকেন বেবি সিনড্রোম হয়েছে?
ডাক্তারবাবুরা বলছেন, তিন ধরনের পরীক্ষা করে বোঝা যায়, মস্তিষ্কে ক্ষত তৈরি হয়েছে কিনা। প্রথমত, এনসেফালোপ্যাথি করে বোঝা যায় ভেতরে চোট রয়েছে কিনা।
দ্বিতীয়ত, সাবডুরাল হেমোরজিক হয়েছে কিনা পরীক্ষা করেন ডাক্তাররা। এতে বোঝা যায়, মস্তিষ্কের ভেতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে কিনা।
তৃতীয়ত, রেটিনাল হেমারেজ পরীক্ষা করা হয়। রেটিনার ক্ষতি হলে চোখ দিয়ে রক্তপাত হয়।
এমআরআই স্ক্যান করে পরীক্ষা করা হয়। রেডিও ওয়েবে মস্তিষ্কের ভেতরে পরিস্থিতির পরিষ্কার ছবি আসে। সিটি-স্ক্যান, ক্রস-সেকশনাল ইমেজ বের করেও দেখা হয় মাথায় চোট আছে কিনা। অনেকসময় অপথ্যালমিক পরীক্ষা করেন ডাক্তাররা। এতে ধরা পড়ে, চোখে ক্ষত তৈরি হয়েছে কিনা। মস্তিষ্কে আঘাত লাগলে তার প্রভাব পড়ে চোখেও।
আপনার আদরের সোনাকে ভালবাসুন, তবে সাবধানে
বাচ্চাদের কোলে নেওয়ার সময় ঘাড়ের নীচে আর পিঠে হাত রাখুন। মাথা আর ঘাড়ে যাতে ঝাঁকুনি না লাগে সেটা দেখতে হবে।
যদি মাথায় লেগে যায়, তাহলে সিপিআর দেওয়ার জন্য নানা পদ্ধতি আছে। এক বছরের নীচের বাচ্চাদের ঘাড়ের নীচে এক হাত রাখতে হবে, অন্য হাতের দুটো আঙুল থাকবে ব্রেস্টবোনে। ঘাড় সোজা করে ধরে রাখতে হবে।
চেস্ট কমপ্রেশন দেওয়া যেতে পারে। ব্রেস্টবোনে কমপ্রেশন দিতে হবে অন্তত ৩০টি। তবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়েই এটা করা ভাল।
যদি বাচ্চার শ্বাসের সমস্যা হয়, তাহলে মুখে শ্বাস দিতে হবে। শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক না হওয়া অবধি এই প্রক্রিয়া করতে হবে।
ডাক্তারবাবুরা বলছেন, শেকেন বেবি সিনড্রোম গুরুতর হলে দৃষ্টিশক্তি চলে যেতে পারে, বধির হয়ে যেতে পারে শিশু। বৃদ্ধি ও বুদ্ধির বিকাশে বাধা আসতে পারে। সেরিব্রাল পলসি হতে পারে শিশুর। তাই সতর্ক থাকবে অভিভাবকদেরই।