১৬ কোটির ইঞ্জেকশনে সুস্থ হায়দরাবাদের আয়াংশ, জেনে নিন শিশুর রোগটা কী

চৈতালী চক্রবর্তী

জটিল জিনবাহিত রোগ স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রপি বা এসএমএ নিয়ে বিশ্বজুড়েই আতঙ্ক। এই রোগ সারবে যে ওষুধে তার একটিরই দাম ১৬ কোটি টাকা। বাকি দুটিও আড়াই-তিন কোটির বেশি। ভারতে সম্প্রতি এই স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রপিতে আক্রান্ত কয়েকটি শিশুর খবর শিরোনামে এসেছিল। যার মধ্যে দিনকয়েক আগেই শোনা গিয়েছিল ১৩ মাসের একটি শিশুকে বহুমূল্য ইঞ্জেকশন দিয়েও বাঁচানো যায়নি। কিন্তু হায়দরাবাদের সেই বছর তিনেকের আয়াংশ যার জন্য ওষুধ কিনতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার, সেই শিশুটি এখন অনেকটাই সুস্থ। জটিল রোগের প্রভাব কমছে ধীরে ধীরে। সোজা হয়ে বসতে পারে শিশুটি, খাবার গিলে খেতেও পারছে। ভারতে এমন জিনবাহিত রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা কম নয়। তাদের বাঁচাতে ও খরচসাপেক্ষ এই চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে উদ্যোগী হয়েছে সরকার। এগিয়ে এসেছে অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও।

ভাল আছে আয়াংশ, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল সরকার ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন

জটিল জিনগত রোগ স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রপিতে আক্রান্ত হয়েছিল ছোট্ট আয়াংশ। ১৬ কোটি টাকা দামের সেই ওষুধ না দিলে প্রাণে বাঁচানোই সম্ভব হত না। মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে এই চিকিৎসার খরচ তোলা ছিল এককথায় অসম্ভব ব্যাপার। বিদেশ থেকে ওষুধ আনানো, তার দাম ও শুল্ক সব মিলিয়ে খরচটা আকাশছোঁয়া। কীভাবে আয়াংশকে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা গেল, সেই কঠিন লড়াইয়ের কথা দ্য ওয়ালকে বললেন আয়াংশের বাবা যোগেশ গুপ্ত।

রোগ ধরা পড়েছিল অনেক দেরিতে। হাঁটাচলা করতে পারত না আয়াংশ, খাবার গিলতে সমস্যা হত। সোজা হয়ে বসতেও পারত না। অনেক ডাক্তার দেখিয়েও রোগ ধরা যায়নি। শুরুতে ডাক্তাররা ভেবেছিলেন বিরল স্নায়ুর রোগে আক্রান্ত হয়েছে আয়াংশ। পরে ধরা পড়ে সে স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রপিতে আক্রান্ত। এই রোগ হলে গোটা স্নায়ুতন্ত্রই পঙ্গু হয়ে যেতে শুরু করে। পেশি অকেজো হতে শুরু করে, ফলে হাত-পা নাড়ানো সম্ভব হয় না। খাবার গিলতে, কথা বলতে সমস্যা হয়, শ্বাসযন্ত্রের রোগও দেখা যায়। এসএমএ হলে দু’বছরের বেশি বাঁচতে পারে না শিশু। আয়াংশের চিকিৎসা করানোই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। যোগেশ বললেন, ডাক্তারবাবুদের সহযোগিতা তো ছিলই, এগিয়ে এসেছিল বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও। দেশে এমন একটি সংগঠন আছে যারা কাজ করে পশ্চিমবঙ্গেও, এসএমএ-তে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা, ওষুধপত্র কেনা সংক্রান্ত যাবতীয় সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করে দেয়।

আয়াংশ এখন অনেক সুস্থ। যোগেশ বললেন, বহুমূল্য ওষুধের ডোজ পড়ার পরেই বাচ্চা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে এমন নয়। ধীরে ধীরে অসাড় অঙ্গগুলো সচল হতে শুরু করবে। থেরাপির পরে ফিজিওথেরাপি সবচেয়ে বেশি কাজে দেয়। মাস দুয়েকের মধ্যে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সচল হতে শুরু করে। আয়াংশ এখন বসতে পারে, খাবার গিলে খেতে পারে। কিছুদিন আগে ইডলিও খেয়েছে সে। আয়াংশ এখন চনমনে, স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করেছে।

ভারতে প্রতি আট থেকে দশ হাজারে একজন শিশু স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রপির শিকার

বিশিষ্ট শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ড. অপূর্ব ঘোষ বলেছেন, স্নায়ুর রোগ যা জিনগত ত্রুটির কারণে এই রোগ হয়ে থাকে।

ড. অপূর্ব ঘোষ

বংশপরম্পরায় ছড়াতে পারে বাবা-মায়ের থেকে সন্তানের শরীরে। হয়। যদি বাবা-মায়ের শরীরে একটি স্বাভাবিক জিন ও অন্যটি পরিবর্তিত মা মিউটেটেড জিন থাকে তাহলে তাঁরা রোগে আক্রান্ত হন না, পরিবর্তে বাহক হয়ে যান। কিন্তু সন্তানের শরীরে দুটি জিনই আসে ত্রুটিযুক্ত হয়ে। তখন রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে।

আমরা জানি, মস্তিষ্ক থেকে স্নায়ুর মাধ্যমে ইলেকট্রিক সিগন্যাল বা বার্তা বা সঙ্কেত চলে আসে পেশিতে। ঐচ্ছিক পেশির সঞ্চালন এই সঙ্কেতের ওপরেই নির্ভর করে। এখন যদি কোনওভাবে মস্তিষ্ক থেকে বার্তা স্নায়ু আর বয়ে নিয়ে যেতে না পারে, তাহলে পেশিও কাজ করা বন্ধ করে দেয়। পেশির সমস্ত সঞ্চালন তথা নড়াচড়া বন্ধ হতে থাকে। ফলে মানুষ আর হাত-পা, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ চালনা করতে পারে না। শিশুরা শুধু নয়, প্রাপ্তবয়স্করাও আক্রান্ত হয় এই রোগে। স্পাইনাল মাসকিউলার অ্যাট্রফির অনেকগুলো ধরন আছে, এর টাইপ-১ ও টাইপ-২ রোগ বেশি মারাত্মক। ঘাড় নরম হয়ে ব্যালান্স হারিয়ে যায়, হাত-পা অবস হতে থাকে, হাঁটাচলা করতে পারে না শিশু। উঠে বসতেও সমস্যা হয়। খাবার গিলতে, কথা বলতে সমস্যা হয়, শ্বাসযন্ত্রের রোগও দেখা যায়। এসএমএ হলে দু’বছরের বেশি বাঁচতে পারে না শিশু। ভারতে প্রতি আট থেকে দশ হাজার শিশুর মধ্যে একজন এই বিরল জিনগত রোগে আক্রান্ত হয় প্রতি বছর।

Muscle Atrophy - The Definitive Guide | Biology Dictionary

ডাক্তারবাবু বললেন, এই রোগের একটি ওষুধের নাম ‘জ়োলজেন্সমা’ যার দাম ও আমদানি খরচ মিলিয়ে ১৬ কোটি টাকা খরচ হয়। এই ওষুধ দেশে আনতে গেলে যে আমদানি শুল্ক লাগে, তা মকুব করে দেয় সরকার। দেশে এখনই ৬০০ থেকে ৭০০ জনের শরীরে স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রপি চিহ্নিত করা গেছে। তাছাড়া রোগ ধরা যায়নি এমন শিশু বা প্রাপ্তবয়স্করাও আছেন। এতজনের জন্য ১৬ কোটির ইঞ্জেকশন বিনামূল্যে দেওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু বিদেশ থেকে এই ওষুধ আমদানি করা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থা করে সরকার। তাছাড়া নোভার্টিস নামে যে কোম্পানি এই ওষুধ তৈরি করে, তারাও ‘ক্রাউডফান্ডিং’ এর ব্যবস্থা করে দেয়। বহু মানুষ সেই ফান্ডে অনুদান দেন। হায়দরাবাদের আয়াংশের থেরাপির সময়ে অন্তত ৬২ হাজার মানুষ স্বেচ্ছায় অনুদান দিয়েছিলেন।

Muscle Atrophy - Assignment Point

এসএমএ আক্রান্তদের বাঁচার পথ দেখাচ্ছে এই সংগঠন

কিওর এসএমএ ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়া নামে একটি সংগঠন এই বিরল জিনগত রোগে আক্রান্ত মৃত্যপথযাত্রীদের বাঁচার পথ দেখাচ্ছে। এই সংগঠনের হেডঅফিস গুরগাঁওতে। কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গেও এসএমএ আক্রান্তদের চিকিৎসা করতে কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে সেই ব্যাপারে সাহায্য করে। এই সংগঠনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও ডিরেক্টর (ইভেন্টস অ্যান্ড ফ্যামিলি সাপোর্ট) মৌমিতা ঘোষ জানালেন, হায়দরাবাদের আয়াংশের টাইপ-১ এসএমএ হয়েছিল। এই রোগে শিশু আড়াই বছরের বেশি বাঁচে না। টাইপ ২ বা টাইপ ৪ এসএমএ-তে ৮-৯ বছর বা ১২ বছর অবধি বাঁচে রোগী। টাইপ ৪ সাধারণত প্রাপ্তবয়স্কদের হয়। হাত-পা পুরোপুরি কার্যক্ষমতা হারায়। এমনকি মশা কামড়ালেও মারতে পারেন না রোগী। কলকাতাতে দুতিন জন, পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জেলাতেও এমন কয়েকজন আছেন।

মৌমিতা বলছেন, এসএমএ রোগের তিন রকম ওষুধ আছে। একটা জোলজেন্সমা যার দাম ১৬ কোটি টাকা। এই ওষুধ ২ বছরের বেশি বয়সি বাচ্চাদের দেওয়া যায় না। ওজন যদি ১৩ বা সাড়ে ১৩ কেজি হয়, তাহলে এই ওষুধ দেওয়া সম্ভব। এখন যদিও ওজন আর একটু বাড়িয়ে ২১ কেজি করা হয়েছে। অন্য দুটো ওষুধের একটা স্পিনরাজ়া যেটা তৈরি করে মার্কিন কোম্পানি। এই ওষুধের থেরাপির প্রথম বছরের খরচ পাঁচ কোটি টাকা, পরের বছর থেকে আড়াই কোটি টাকা। ভারতে এই ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে এখন। পশ্চিমবঙ্গ থেকেই ৮ জন এই ওষুধ পাচ্ছেন। তৃতীয় ওষুধের নাম এভারেসডি। এই ওষুধের থেরাপির খরচ প্রায় ৭২ লক্ষ টাকা। তবে ভারতে গত ১০ জুলাই এই ওষুধটি লঞ্চ হয়েছে। দেশে এসএমএ আক্রান্তদের এখন বিনামূল্যে এই ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। দেশের ৭২ জন এই ওষুধ কিছু বছরের জন্য বিনামূল্যে পাবেন। পশ্চিমবঙ্গে এখন তিনজন এই ওষুধ পাচ্ছেন, আরও চার জনের থেরাপিও হবে এই ওষুধে।

আয়াংশের বাবা যোগেশ গুপ্তও এই সংগঠনের কথা বলেছেন। https://curesmaindia.org/ ওয়েবসাইটে গিয়ে যোগাযোগ করলে আক্রান্ত রোগীর থেরাপি কী পথে হতে পারে, কোন ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, কোথা থেকে কীভাবে ওষুধ পাওয়া যাবে, ইত্যাদি যাবতীয় ব্যাপারে রোগী ও তাঁর পরিবারকে সাহায্য করেন এখানকার বিশেষজ্ঞরা।