
সিজন চেঞ্জে বাচ্চাদের কানে ব্যথা, চুলকানি থেকে পুঁজ, সতর্ক থাকুন বাবা-মায়েরা
দ্য ওয়াল ব্যুরো: সিজন চেঞ্জ মানেই বাচ্চাদের সর্দিকাশি। গলা খুশখুশ। কানে ব্যথা। বৃষ্টির সময় যেমন সর্দিকাশি, জ্বর লেগেই থাকে বাচ্চাদের। তেমনি ঠান্ডা পড়ার সময় থেকেই ভোগান্তি বাড়ে। মরসুমের বদলে আবহাওয়ার হঠাৎ পরিবর্তন বাচ্চারা সামলে উঠতে পারে না। ফলে সর্দি-জ্বর লেগেই থাকে। কখনও ভাইরাস সংক্রমণে নাক, কান, গলায় ব্যথা শুরু হয়। মরসুম বদলের সময়ে বাচ্চাদের সুস্থ রাখা যাবে কীভাবে সে প্রশ্নটাই বেশিরভাগ বাবা-মায়েরা করেন।
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বড়দের সঙ্গে লাইফস্টাইলে পাল্লা দিয়ে গিয়ে ছোটরাও ভুগতে থাকে। ঠান্ডায় বাইরে বেশি ঘোরাঘুরি, শপিং মল, সিনেমা হলের বদ্ধ জায়গায় বেশি ঠান্ডায় অনেক সময়েই ইনফেকশন হয়ে যায়। বিশেষত ৬ বছরের নিচে বাচ্চাদের কানের সমস্যা বড় ভোগায়। কানে ব্যথা, পুঁজ, কানের ভেতর জল জমে সংক্রমণ হয়ে যায় অনেক সময়েই। সেখান থেকে জ্বর, শারীরিক দুর্বলতা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাচ্চাদের এই ব্যাপারটায় বেশি খেয়াল রাখতে হবে। প্রথমত, সর্দি-কাশি, কফ যাতে বুকে বসে না যায় সেদিকে নজর দিতে হবে। কী ধরনের সংক্রমণ হচ্ছে, ভাইরাল ফ্লু কিনা সেটা পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া জরুরি। দ্বিতীয়ত, কানে ব্যথা হলে হেলাফেলা করা উচিত নয় একেবারেই। কানের ভেতর ময়লা জমে আছে কিনা, বা খোঁচাখুঁচিতে ঘা বা সংক্রমণ হয়েছে কিনা সেটা দেখতে হবে। ব্যথা বাড়লে সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত। অনেকেই আবার কানের ব্যথায় নিজেরাই ডাক্তারি করে নানারকম বাজার চলতি ড্রপ দেন বা ওষুধ খাওয়ান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন করলে হিতে বিপরীত হবে।
ঠান্ডা লেগে কানে চুলকানি, যন্ত্রণা, বাচ্চাদের খেয়াল রাখতে হবে
ঠান্ডা থেকে কানের ভেতরে সংক্রমণ হতে পারে বাচ্চাদের। সাধারণত মধ্যকর্ণের ইউস্ট্যাচিয়ান টিউবে সংক্রমণ হতে দেখা যায়। এই চ্যানেল হয়েছে মধ্যকর্ণের ফ্যারিংস থেকে ক্যাভিটির মধ্যে।
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছয় থেকে আট বছরের বাচ্চাদের কানের সংক্রমণ বেশি হতে দেখা যায়। এর কারণ যেমন সর্দি-কাশি ঠান্ডা লাগা, তেমনি ভাইরাসের সংক্রমণও। ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাস অর্থাৎ যখন শীতের পরে গরম আসে, জুলাই থেকে অগস্ট অর্থাৎ বর্ষার সময় এবং অক্টোবর থেকে নভেম্বরে অর্থাৎ শীতের শুরুতে কানে সমস্যা হতে পারে। এই সময়ে সর্দি-কাশিও বেশি হয়। ঠান্ডা লেগে বুকে সর্দি-কফ জমে গেলেও কানের সমস্যা বাড়তে পারে।
কানের কাজ শুধু শোনা নয়, দেহের ভারসাম্য রক্ষা করাও। তাই কানের যত্ন গুরুত্ব দিয়ে নেওয়া উচিত। কানের ভেতরের অংশকে রক্ষা করার জন্য মোমের মতো বস্তু থাকে। একে ইয়ারওয়াক্স (Earwax) বা চলতি কথায় কানের খোল। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই কানের ময়লা কিন্তু আসলে কানকে সুরক্ষা দেয়। এটি আসলে কানের বাইরে থাকা সিবেসিয়াস গ্রন্থির (Sebaceous Gland) ক্ষরণ যাকে বলে সেরুমেন (Cerumen)। এর মধ্যে থাকে কেরাটিন (৬০%), স্যাচুরেটেড এবং আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড (১২-২০%) এবং কোলেস্টেরল (৬-৯%)। এই ক্ষরণ হলদেটে হয়, এরই সঙ্গে বাইরে ধুলো-ময়লা ইত্যাদি মিশে একটা বিদঘুটে রঙ ও আকার নেয়। এই ময়লা পরিষ্কারের সময় অনেকেই কানের ভেতর খোঁচাখুঁচি করেন, যে কারণেও সংক্রমণ হতে পারে। বাচ্চাদের অনেক সময়েই ইয়ারবাড দিয়ে কান পরিষ্কার করানো হয়, জোর করে টানাটানি করতে গিয়ে ইউস্ট্যাচিয়ান টিউবে লেগে গিয়ে সংক্রমণ হতে পারে।
সংক্রমণ হয়েছে কানে, কী কী উপসর্গ দেখে সতর্ক হতে হবে
শিশুদের ক্ষেত্রে এই সতর্কতা বেশি জরুরি। কারণ বাচ্চারা অনেক সময়েই বুঝতে পারে না কী সমস্যা হচ্ছে। কানে ব্যথা হলে বাব-মায়েরা ভাবেন সামান্য ঠান্ডা লেগে হতে পারে। তবে অনেক সময়েই সংক্রমণ গভীরে ছড়িয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কানে ক্রমাগত চুলকানি হলে সতর্ক হতে হবে।
কানের ভেতরে পুঁজ বা জল জমেছে কিনা দেখতে হবে।
অনেক সময় কানের ভেতর জল জমলে পুঁজের মতো তরল তৈরি হয়। তখন শোনার সমস্যা হয়। কানের ভেতরে শোঁ শোঁ আওয়াজ তে থাকে। মাথাও ঘুরতে থাকে অনেকের। বাচ্চারা এমন কিছু বললে সাবধান হতে হবে।
অনেক সময় ভাইরাল ইনফেকশন হয়ে জ্বর হয় বাচ্চাদের। শরীরে তাপমাত্রা হঠাৎ বেড়ে যায়। শ্বাস নিতে সমস্যা হতে পারে। সেই সঙ্গে কানেও যন্ত্রণা শুরু হয়। ঘন ঘন সর্দি-কাশি-জ্বর হতে থাকলে কানের পর্দার পেছনে শ্লেষ্মা জমে। তার থেকে বাচ্চা কানে কম শোনে। সাইনাসের সমস্যাও দেখা দিতে পারে। এমন হলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
বাচ্চাদের কয়েক ধরনের সংক্রমণ হয় কানের ভেতরে—অ্যাকিউট ওটিটিস এক্সটারনা, ওটিটিস মিডিয়া, অ্যাকিউট ওটিটিস মিডিয়া ইত্যাদি। উপসর্গ অনেকটা একই। তাই ঘন ঘন কানের সমস্যা হলে ডাক্তারের কাছে পরীক্ষা করিয়ে নেওয়াই ভাল।
বাচ্চাদের কানের যত্ন কীভাবে নেবেন
ঠান্ডা লাগলে কান দিয়এ পুঁজ বা চটচটে তরল বের হচ্ছে কিনা সেটা আগে খেয়াল রাখতে হবে। তেমন হলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
ইয়ারবাড বা কাঠির আগায় তুলো গুঁজে কান পরিষ্কার করা নৈব নৈব চ। খোঁচাখুঁচিতে বিপদ আরও বাড়বে। অনেকেই কান ব্যথা বলে গরম তেল দেন। সেটা সাময়িক আরাম দেয়। কিন্তু কানের ক্ষতি করতে পারে।
একদম ছোট বাচ্চাদের স্নান করানোর সময় দুই কান হাত দিয়ে ছেপে মাথায় জল ঢাললে ভাল হয়। কানের ভেতরে যাতে জল না জমে যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কোলে শুইয়ে দুধ বা জল খাওয়ানোর সময়েও বাচ্চাদের মাথা কিছুটা উঁচুতে রাখা ভাল। অনেকসময়েই এই তরল নাকের মধ্যে দিয়ে মধ্যকর্ণে ঢুকে পড়ে পুঁজ তৈরি করে।
কানের ড্রপ ব্যবহার করতে হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে করাই উচিত। বাচ্চাদের খোলামেলা জায়গায় খেলতে পাঠান। বাচ্চার যদি ঠান্ডা লাগার ধাত থাকে তাহলে বদ্ধ জায়গা বা যেখানে সর্বক্ষণ এসি চলছে, তেমন জায়গায় না পাঠানোই ভাল। কানে ব্যথা হচ্ছে কিনা, শুনতে সমস্যা হচ্ছে কিনা, সেটা বারে বারেই জিজ্ঞেস করে জেনে নেবেন।
অনেক সময় অতিরিক্ত খোঁচাখুঁচিতে কানে ব্যথা হয়। সেক্ষেত্রে গরম জলের ভাপ নিলেও ব্যথা কমে। হালকা করে উষ্ণ গরম জলে কাপড় ভিজিয়ে কানের যতটা অংশ পারেন ভাল করে মুছে দিন, তাতেও কান পরিষ্কার থাকবে।
স্নানের সময় কানের আঙুলে করে কানের ভিতর তেল মালিশ করার অভ্যাস অনেকেরই আছে। ছোট বাচ্চাদেরও তেমনটাই করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পদ্ধতি কিন্তু বিজ্ঞানসম্মত। গরম তেল নয়, মিনারেল বা অলিভ ওয়েল যদি রোজ আঙুলে করে নিয়ে কানের ভিতর মালিশ করা যায় তাহলে কানে ময়লা জমতে পারে না। কানও অনেক হাইড্রেটেড থাকে।
ছোট বাচ্চারা ইয়ারফোন যতটা কম ব্যবহার করে, ততটাই ভাল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইয়ারফোন থেকেও কানে সংক্রমণ ছড়াতে পারে।