
পুষ্টিগুণে অনেক পিছিয়ে বাজারচলতি ‘হেলদি ফুড’, ক্ষতিই বাড়ছে শরীরের
সঞ্চিতা চট্টোপাধ্যায়
খাদ্যাভ্যাস এবং শারীরিক সুস্থতা নিয়ে এখন সকলেই সচেতন। ভাল থাকতে ‘হেলদি ফুড’ খুঁজে খান অনেকেই। ইদানীং বহু প্রাকৃতিক খাবারকেই প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে ‘হেলদি’ ভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে বাজারে। তবে এসব খাবার আদতেই কতটা স্বাস্থ্যসম্মত, তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে যথেষ্ট।
১. লো ফ্যাট অথবা ফ্যাট ফ্রি খাবার:
এগুলি আসলে আল্ট্রাপ্রসেসড এবং চিনিযুক্ত। এগুলো খেলে ইনসুলিন স্পাইক হয় তার ফলে পেটে মেদ জমা, হরমোনের ব্যালেন্স নষ্ট হওয়া– এসব নানাসমস্যা দেখা দিতে পারে।
২. স্যালাড:
শুনতে খুব হেলদি ফুড বলে মনে হলেও, এর ড্রেসিংগুলো যথেষ্ট পরিমাণে ট্রান্সফ্যাট যুক্ত হয়, যা রক্তবাহী নালিতে অবরোধ তৈরি করে। ফলে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৩. ফলের রস
প্রতিদিন ফল খাওয়া জরুরি। তবে দোকান থেকে কেনা ফলের রস আসলে লিকুইড সলিউশন ছাড়া কিছুই নয়। কিছু কিছু ফ্রুট জুসে কোনও ফ্রুটও থাকে না, শুধু রাসায়নিক দিয়ে ফলের মতো গন্ধ ও স্বাদ তৈরি করা হয়। এগুলি থেকে ওজন বেড়ে যাওয়া এবং অতিরিক্ত ফ্রি সুগার থাকার জন্য ইনসুলিন স্পাইক জনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৪. গোটা গমের তৈরি খাবার:
ময়দার তৈরি খাবারের থেকে গোটা গমের খাবারকে বেশি স্বাস্থ্যকর বলা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে গমকে পালভারাইজার দিয়ে একেবারে ফাইন টেক্সচার করা হয় যার ইনডেক্স ময়দার সমতুল্য। তাই গোটা গমের থেকে আদতে স্বাস্থ্যের কোনও উপকার হয় না।
৫. মার্জারিন
এটিকে বাটারের স্বাস্থ্যকর রিপ্লেসমেন্ট বলে দাবি করা হলেও আসলে এটি রিফাইন্ড অয়েলের হাইড্রোজিনেশন করে তৈরি করা হয়। ফলে এতে প্রচুর পরিমাণে ট্রান্সফ্যাট থাকে, যা রক্তবাহী নালিতে রক্ত জমাট বাঁধিয়ে ফেলে। বরং গরুর দুধ থেকে তৈরি মাখন অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর।
৬. ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল
ওটস, বার্লি, রাগী, গম– এসব দিয়ে তৈরি সিরিয়ালের প্যাকেটকে স্বাস্থ্যকর বলে দাবি করা হলেও, অনেক ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল শুধু শিশুদের জন্যই পুষ্টিকর বলে উল্লেখ করা হয়। এগুলিতে লো ক্যালোরি, লো ফ্যাট ও আরও অনেক কিছু লেখা থাকলেও, এই ধরনের সিরিয়ালগুলিকে বিভিন্ন মেকানিক্যাল প্রসেসিংয়ের মধ্যে দিয়ে রোস্টেড, ফোল্ডেড, রোলড করা হয়। এগুলিতে অতিরিক্ত চিনি, প্রিজারভেটিভ, আর্টিফিশিয়াল কালার ও ফ্লেভার থাকে। এটি নিয়মিত খেলে শরীরে ইনফ্ল্যামেশন তৈরি হয়, যা থেকে হরমোনাল ইমব্যালেন্স, বেলিফ্যাট, পিএমএস, পিসিওডি প্রভৃতি লাইফস্টাইল ডিজিজ হতে পারে।
৭. হেলথ ড্রিঙ্ক
বহুল ব্যবহৃত এই পানীয় বেশির ভাগ সময়েই ঠিকমতো ঘনত্বের বানানো হয় না। ফলে সেভাবে শরীরে কাজও করে না। আর খাদ্যতালিকা সুষম হলে এই ধরনের মিল রিপ্লেসমেন্ট নেওয়ার প্রয়োজনই নেই। এগুলোতেও আর্টিফিশিয়াল কালার, ফ্লেভার, প্রিজারভেটিভ প্রভৃতি রাসায়নিক মেশানো থাকে। কোনও কারণে কেউ প্রাকৃতিক খাবার খেতে না পারলে তখনই রিপ্লেসমেন্ট ড্রিঙ্কের সাহায্য নিতে হবে। বাচ্চাকে চটজলদি বড় করতে বা বুদ্ধিমান করতে এগুলির ভূমিকা নেই।
৮. চটজলদি রান্না করা যায় এমন স্ন্যাক্স
এই ধরনের খাবারগুলির মেয়াদ বাড়াতে এবং আরও সুস্বাদু ও আকর্ষণীয় করার জন্য নানা রাসায়নিক মেশানো হয়। লবণ এবং ফ্যাটের মাত্রাও খুব বেশি থাকে। মেশানো হয় পাম অয়েল, যাতে ট্রান্সফ্যাট থাকে। তাই এই সব খাবার ব্যবহারের আগে লেবেল দেকে নিতে হবে।
৯. বেকিং করা চিপস
এই ধরনের চিপস খেলে শরীরে কিছু ক্যালরি এবং ফ্যাট হয়তো কম যাবে, একথা ঠিক। তবে প্রচুর পরিমাণে সোডিয়াম ও অ্যাক্রিলামাইড ঢুকবে শরীরে। তাই স্ন্যাক্স হিসেবে শুকনো খোলায় ভাজা মুড়ি, চিঁড়ে, পপকর্ন, ছোলা, বাদাম, খই, কুমড়ো বীজ, সাদা তিল বা ফ্ল্যাক্স সিড খান।
১০. ডায়েট কোক
অতি জনপ্রিয় পানীয় হলেও, এর নিউট্রিশন ভ্যালু প্রকৃতই জিরো। এটা খেলে শরীরে যায় শুধুই কিছু ক্ষতিকারক কেমিক্যালস আর কিছু পরিমাণ সোডিয়াম। এর সঙ্গে মিশ্রিত অ্যাসিড দাঁতের এনামেলও নষ্ট করে।
১১. হাই ফাইবার বিস্কুট
এই বিস্কুটে কিছুটা বেশি ফাইবার মিললেও তাতে সুগার অ্যাডিটিভস, প্রিজারভেটিভ প্রভৃতি রাসায়নিক মেশানো থাকে। তাই নিয়মিত খেলে শরীরে কুপ্রভাব পড়তে বাধ্য।
বস্তুত, যে কোনও বাজারজাত ‘হেলদি ফুড’ই আসলে আল্ট্রা প্রসেসড হয় এবং প্রচুর রাসায়নিক ব্যবহার করে এদের আকর্ষণীয় ও সুস্বাদু করে তোলা হয়। তাই এগুলি যতটা হেলদি বলে নিজেদের দাবি করে, এরা আসলে ততটাই বিপজ্জনক হতে পারে।
ফলে খাবার কেনার আগে তার গায়ে সাঁটা লেবেলে কী লেখা আছে পড়ুন। সম্ভব হলে এধরনের খাবার এড়িয়ে গিয়ে প্রাকৃতিক খাবারই রাখুন আপনার খাদ্যতালিকায়। প্রচুর পরিমাণে জল খান, প্রতিদিন ব্যায়ামের ও ভাল ঘুমের অভ্যাস গড়ে তুলুন। পজিটিভ কথা ভাবুন। তাহলেই স্বাস্থ্য থাকবে আপনার হাতের মুঠোয়। বাজারের ‘হেলদি ফুড’ বাদ দিয়েই সুস্থ থাকুন, ভাল থাকুন।