
রক্ত-মাংস দেখে আনন্দ, ঠান্ডা মাথায় খুন করেও স্বাভাবিক, কী ধরনের মানসিক অসুস্থতায় ভুগছে আফতাবরা
গুড হেলথ ডেস্ক
২০০৫-০৬ সালের একটি ঘটনা হাড়হিম করে দিয়েছিল। নয়ডার নিঠারিতে এক ব্যবসায়ীর বাড়ির কেয়ারটেকার হয়ে উঠেছিল সিরিয়াল কিলার। ছাপোষা চেহারা, মার্জিত কথাবার্তা, নরম স্বভাবের মানুষটাকে দেখে ঘুণাক্ষরেও বোঝা যেত না তার ভেতরে এক নৃশংস খুনি লুকিয়ে রয়েছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ভুলিয়ে ভালিয়ে ধরে এনে তাদের ধর্ষণ করে নির্মমভাবে হত্যা করত, তারপর দেহ শত টুকরো করে ফেলে দিত ড্রেনে। তার নাম ছিল সুরিন্দর কোলি। সারা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল সেই ঘটনা। সুরিন্দরকে জেরা করতে গিয়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল পুলিশও। অনুশোচনার বিন্দুমাত্র ছিল না তার কথায়। এত অজস্র খুন করার পরেও সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত ও স্বাভাবিক ছিল সে।
কেরলের নরবলি কাণ্ডের কথা মনে পড়ে যায়। মহম্মদ শফি ওরফে রশিদ এক অদ্ভুত রকমের মানসিক বিকারের শিকার হয়েছিল। মানুষ ধরে এনে বলি দিয়ে তাদের গোপনাঙ্গ কেটে নিত রশিদ। মহিলাদের স্তন ও যোনি কেটে তা রেখে দিত নিজের কাছে। রক্ত-মাংস দেখে আনন্দ পেত।

দিল্লির নৃশংস হত্যাকাণ্ড এমন আরও অনেক বিভীষিকাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। দেশে এমন ঘটনা বহুবার ঘটেছে এবং ঘটে চলেছে। আফতাব আমিন পুনাওয়ালা ( Aaftab Ameen Poonawala) তার প্রেমিকাকে খুন করে দেহ কচুকাটা করেছে। ১০ ঘণ্টা ধরে তার লিভ-ইন সঙ্গী শ্রদ্ধার দেহের ৩৫ টুকরো করেছে। মাঝে বিরতি নিয়েছে, খাবার অর্ডার দিয়ে খেয়েছে, নেটফ্লিক্সে ওয়েব সিরিজও দেখেছে। বিশ্রাম নিয়ে আবার দেহ কাটতে বসেছে। অর্থাৎ এই পুরো ব্যাপারটার মধ্যে তার কোনওরকম ভয়, অনুশোচনা, দুঃখ, ঘৃণা বা অপরাধবোধ কাজ করেনি। প্রেমিকার কাটা দেহাংশ নিজের হাতে ধুয়ে পরিষ্কার করে প্যাকেটে মুড়িয়ে ফ্রিজে রেখেছে, কাটা মাথা সাজিয়ে রেখেছে ফ্রিজে। সেই কাটা মাথার সঙ্গে নাকি কথাও বলত সে। এতকিছুর পরেও স্বাভাবিক জীবন কাটিয়েছে। বাড়িতে মেয়েদের ডেকে এনে উদ্দাম যৌনতায় মেতেছে। তার চেহারা, আচরণ ও ব্যবহারেও কোনও অস্বাভাবিকতা দেখা যায়নি।
মনোবিদেরা বলছেন, এই ধরনের মানসিকতাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় অ্যান্টি-সোশ্যাল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার (antisocial personality disorder)। ঠান্ডা মাথায় খুন করা, রক্ত-মাংস দেখে আনন্দ পাওয়া, আবার পরক্ষণেই স্বাভাবিক হয়ে যাওয়া, কথাবার্তাতেও স্বাভাবিক থাকা–এইসবই তাদের দ্বৈত সত্তার পরিচয়। বাইরে থেকে এদের দেখলে বোঝাই যাবে না, আপাত নিরীহ ও মার্জিত চেহারার আড়ালে কী ভয়ঙ্কর নৃশংসতা ও বর্বরতা লুকিয়ে আছে। মনোবিদদের মতে, এই ধরনের মানসিকতা একদিনে আসে না। এদের কাউন্সেলিং করলে বোঝা যাবে, ছোট থেকেই আচরণ ও অভিব্যক্তিতে অস্বাভাবিকতা ছিল, তা ধরা পড়েনি সাধারণের চোখে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক বিকার বেড়েছে। একের পর এক ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটিয়েছে তারা।
পেশাদার খুনিরাই কি অ্যান্টি-সোশ্যাল ডিসঅর্ডারে ভোগে? মনোবিদেরা বলছেন, একেবারেই না। দেশে এমন যত ঘটনা ঘটেছে সেগুলি ভালকরে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বেশিরভাগেরই অতীতে কোনও অপরাধ করার রেকর্ড নেই। নিজের পরিবারের কাছে ও কর্মস্থলে এরা খুব ভাল মানুষ হিসেবে পরিচয় রেখেছে, অনেকে আবার সোশ্যাল মিডিয়াতেও জনপ্রিয়। কোনও ক্ষেত্রেই অপরাধী পেশাদার খুনি নয়। অথচ যে ভাবে সে খুন করেছে বা খুনের পর দেহ লোপাট করার চেষ্টা করেছে— তা এক কথায় রোমহর্ষক হলিউডি ছবিকেও হার মানাবে অনায়াসে। ঝানু গোয়েন্দারাও নাকানিচোবানি খেয়েছেন অনেক ক্ষেত্রে। অনেক মামলার সমাধানও হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ছোটবেলায় কোনও মানসিক আঘাত, ট্রমা, যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া বা বাবা-মায়ের মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েন, শৈশবে মানসিক ও শারীরিক হেনস্থা হলে, ছেলেবেলায় বাবা-মায়ের সাহচর্য না পেলে এমন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, খুনের পরে এরা তাদের আক্রোশ মিটিয়েছে। দেহ টুকরো করে বা মৃতদেহকে ধর্ষণ করে নিজেদের পুরনো রোষ মিটিয়েছে। মনের স্থিতি ঠিক কোন পর্যায়ে গেলে এমন নৃশংস আচরণ করা যায় এটাই তার প্রমাণ।
অ্যান্টি-সোশ্যাল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার অনেক রকম হয়। হিংসা, নিষ্ঠুরতা, প্রতিহিংসা ইত্যাদি মনের এমন নানা স্থিতিতে ভোগে তারা। কেউ ইন্ট্রোভার্ট হয়, চুপচাপ-নিরীহ গোছের চেহারা, আবার কেউ সমাজমাধ্যমে খুব অ্যাকটিভ ও জনপ্রিয়। দিল্লির খুনি আফতাব যেমন সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব অ্যাকটিভ ছিল। নারীদের অধিকার নিয়ে রীতিমতো ক্যাম্পেন করত সে। আর এদিকে নিজের প্রেমিকাকেই খুন করে দেহ কচুকাটা করে। মনোবিদদের মতে, সচেতনভাবে বা অবচেতনে হিংসাত্মক প্রবৃত্তি লুকিয়ে থাকে। অনেক সময় subconscious cruelty দেখা যায়। এরা এমন একধরনের সাইকোপ্যাথ যারা নির্লিপ্তভাবে খুন করতে থাকে। কেরলের নরবলি কাণ্ডে এমনটাই দেখা গিয়েছিল।
আবার aggressive mutilation দেখা যায়। এক্ষেত্রে নিজের কোনও রাগ বা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য এরা খুন, ধর্ষণ করতে থাকে। জঙ্গি সংগঠন আইসিসের মধ্যে এমন হিংস্র প্রবৃত্তি দেখা যায়। জনসমক্ষে মাথা কেটে এবং তা সবাইকে দেখিয়ে তারা আনন্দ পায়।
offensive mutilation আরও একধরনের মানসিক বিকার। এক্ষেত্রে ধর্ষণ, মৃতদেহের সঙ্গে সঙ্গম এমন ধরনের বিকারগ্রস্ততা দেখা যায়। দিল্লিতে নির্ভয়া গণধর্ষণকাণ্ডে অপরাধীদের জেরা করে এমনই জানতে পেয়েছিলেন সাইকোথেরাপিস্টরা। ধর্ষণের পরে নির্ভয়ার গোপনাঙ্গে রড ঢুকিয়ে নির্যাতন, পেটের ভেতর থেকে নাড়িভুঁড়ি বের করে আনন্দ পেয়েছিল ধর্ষকরা।

নরখাদক বা cannibalism আরও একধরনের মেন্টাল ডিসঅর্ডার। নয়ডার সুরিন্দর কোলি বাচ্চাদের খুন করে দেহ শত টুকরো করে ড্রেনে ফেল দিত ঠিকই, কিন্তু জেরায় সে জানিয়েছিল খুনের পরে বাচ্চাদের মাংস খেতে তার ভাল লাগত। প্রতিবারই বাচ্চাদের খুন করে দেহ কাটার পরে কয়েক টুকরো মাংস সে রান্না করে খেত।

সাইকোপ্যাথদের কাহিনি বলে শেষ করা যাবে না। এমন সাইকোটিক খুনের আরও এক উদাহরণ হল উত্তরপ্রদেশের রাজা কোলান্দার। ২০০০ সালে গ্রেফতার হয়েছিল কোলান্দার। তার আগে অন্তত ১৫ জনকে খুন করে তাদের মাথার ঘিলু বের করে স্যুপ বানিয়ে খেয়েছিল সে। নেটফ্লিক্সে তাকে নিয়ে ডকুমেন্টারিও হয়।
দেহরাদূনের রাজেশ গুলাটির অপরাধের সঙ্গে আফতাবের ঘটনার অনেক মিল আছে। নিজের স্ত্রী অনুপমাকে খুন করে দেহ টুকরো টুকরো করেছিল রাজেশ। স্ত্রীয়ের দেহাংশ ও কাটা মাথা ফ্রিজে রেখে দিয়েছিল। সেখানেও সংসারে অশান্তি, বিবাহ বহির্ভূত প্রেম হয়ে উঠেছিল কারণ। পুলিশ জানিয়েছিল, আগে থেকেই মানসিক সমস্যা ছিল রাজেশের। তাকে দেখে ধরা যায়নি।

বিহারের চন্দ্রকান্ত ঝা-কে নিয়ে তো নেটফ্লিক্সে ডকুমেন্টারিও তৈরি হয়েছে। ২০১৩ সালে ধরা পড়ে চন্দ্রকান্ত। তার অপরাধ প্রবণতা ছিল অন্যরকম। ২০০৩ থেকে ২০০৭ সাল অবধি একাধিক খুন করেছে চন্দ্রকান্ত। প্রতিবার খুনের পরে দেহ টুকরো টুকরো করে সেই টুকরোগুলো দিল্লি তিহার জেল চত্বরে প্যাকেটে মুড়ে ফেলে দিয়ে আসত। সঙ্গে থাকত চিঠি। তাতে বিভিন্ন ফোন নম্বর লিখে দিয়ে আসত চন্দ্রকান্ত। পুলিশকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ করে লিখত–ক্ষমতা থাকলে তাকে গ্রেফতার করে দেখাক। এই অপরাধীকে ধরতে নাকানিচোবানি খেতে হয় দুঁদে পুলিশ কর্তাদেরও। এখন আপাতত তিহার জেলেই বন্দি এই অপরাধী।

মনোবিদেরা বলছেন, রাগ পুষে রাখার প্রবণতা দেখা যায় অ্য়ান্টি-সোশ্যাল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারে। এই ধরনের সাইকোপ্যাথরা দীর্ঘ সময় ধরে রাগ গোপন করে রাখতে পারে। ভেতরে ভেতরে আক্রোশ জন্ম নেয়। ঠান্ডা মাথায় খুনের পরিকল্পনা করতে পারে এরা। অপেক্ষা করে সময় এবং সুযোগের। যেদিন রাগ মাত্রা ছাড়ায় সেদিনই অপরাধ ঘটিয়ে ফেলে তারা। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হল অপরাধের পরেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারে। আর পাঁচজনের মতো করে চলতে শুরু করে, ফলে বোঝার উপায়ই থাকে না কী সাঙ্ঘাতিক অপরাধ এরা ঘটিয়ে চলেছে।
মনোবিজ্ঞান বলছে, অল্প বয়স থেকেই যদি স্বভাবে, আচার-আচরণে কোনওরকম অস্বাভাবিকতা, আক্রমণাত্মক মনোভাব বা হিংস্রতার সামান্য লক্ষণও দেখা দেয়, তাহলে মনোবিদদের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। খেলার ছলেও বাচ্চারা অনেক ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। অনেক সময়েই অভিভাবকেরা বাচ্চা ভেবে এড়িয়ে যান। ফলে পরবর্তীতে এইসব বাচ্চার মধ্যেই নৃশংস মনোবৃত্তির জন্ম হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পৈশাচিক কাণ্ড ঘটাতেও এরা পিছপা হয় না। তাই সাবধান থাকতে হবে শুরু থেকেই। শৈশবে ধরা পড়লে পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার সারিয়ে তোলা যায়।