
কলেরার মড়ক, শরণার্থী শিবিরগুলিতে লাশ পচা গন্ধ, প্রাণ বাঁচাতে ‘ভগবান’ হয়ে এসেছিলেন ওআরএসের স্রষ্টা
গুড হেলথ ডেস্ক
সালটা ১৯৭১। ও পারে মুক্তিযুদ্ধ, এ পারে ভিটেমাটি হারাদের ভিড় উদ্বাস্তু শিবিরগুলিতে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বনগাঁর রিফিউজি ক্যাম্পগুলিতে আচমকাই মহামারী হয়ে আছড়ে পড়ল কলেরা। দিনকয়েকের মধ্যেই মড়ক লেগে গেল ক্যাম্পগুলিতে। বমি, মলমূত্র, মৃতদেহের পচা গন্ধে শরণার্থী শিবিরগুলিতে শ্মশানের স্তব্ধতা নামল। পূতিগন্ধময় শিবিরে যেতে চান না কোনও ডাক্তারই। সেই সময় ‘ভগবান’ হয়ে এলেন এক বাঙালি চিকিৎসক-বিজ্ঞানী। মৃতপ্রায় রোগীদের প্রাণ বাঁচালেন তাঁর তৈরি অবর্থ্য ওষুধে। বমি-দাস্ত, মৃতদেহের পচা গন্ধে সেদিন পিছু হটেননি তিনি।
ডাক্তারের বয়স ৩৭। দু’তিন জনকে নিয়ে তিনিই এলেন বনগাঁ সীমান্তের সেই ক্যাম্পগুলিতে। ভেতরে ঢোকা যায় না। শিবিরগুলির মাটিতে মল-মূত্রের স্রোত। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মৃতদেহ। সেগুলিতে আবার পচন ধরছে। দাহ করার কেউ নেই। মৃতদেহের সারি টপকে, বমি-পায়খানার মধ্যে দাঁড়িয়েই একের পর এক আক্রান্তকে ওআরএস দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। রিহাইড্রেশন ইনট্রাভেনাস থেরাপির (IRT) জন্য সূঁচ দিয়ে স্যালাইন ওয়াটার দিতে হয় রোগীকে। কলেরা সারানোর সেটাই একমাত্র উপায় তখন। কিন্তু সে থেরাপি করার উপায় নেই। কারণ স্যালাইন ওয়াটারই নেই ক্যাম্পগুলিতে। ডাক্তারবাবু তখন নিজের পদ্ধতির প্রয়োগ করলেন। তৈরি করলেন নুন-চিনি-সোডিয়ামের জল (ORS)। তাই দিলেন মৃত্যুপথযাত্রীদের।
কাজও হল ম্যাজিকের মতো। ধীরে ধীরে চোখ খুললেন রোগীরা। বন্ধ হল বমি, পায়খানা। আবিষ্কার হল ডায়েরিয়া, ডিহাইড্রেশনের জীবনদায়ী ওষুধ ওরাল রিহাইড্রেশন সল্ট বা ওআরএস (ORS)। আবিষ্কর্তা বাঙালি বিজ্ঞানী ডা. দিলীপ মহলানবিশ। সাড়া ফেলে দিল তাঁর আবিষ্কার। সেই ১৯৭১ সাল থেকে আজ অবধি বিশ্বজুড়ে কম করেও ৭ কোটি মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে ডা. দিলীপ মহলানবিশের তৈরি ওআরএস।
পরবর্তী সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) একটি কনফারেন্সে গিয়ে ওআরএস তৈরির সেই কাহিনী বলেছিলেন ডা. মহলানবিশ। শুনিয়েছিলেন সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা। ডা. মহলানবিশ বলেছিলেন, রিফিউজি ক্যাম্পগুলোর তখন ভয়ঙ্কর অবস্থা। শয়ে শয়ে মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হচ্ছে। মড়ক লেগে গেছে। মাটি ভেসে যাচ্ছে মানুষের মলমূত্র, বমিতে। তার মধ্যে দাঁড়িয়েই ইনট্রাভেনাস ইঞ্জেকশন (ORS) দিয়ে গেছেন তিনি ও তার সহকর্মীরা। কিন্তু তরল স্যলাইন এক সময়ে শেষ হয়ে যায়। ইনট্রাভেনাস ইঞ্জেকশন পুশ করার লোকেরও অভাব। সেই সময় তিনি নতুন পন্থা বের করেন।
“মানুষগুলোকে বাঁচাতেই হবে। পিছু হটলে চলবে না। এদিকে স্যালাইন সলুউশন শেষ। তখন ঠিক করলাম নিজেই নুন-চিনি-সোডিয়ামের জল (ORS) বানিয়ে নেব। এই সলুউশন কী প্রভাব ফেলবে তখনও জানি না, কিন্তু সেই সময় ঝুঁকিটা নিতেই হয়েছিল”, হু-কে বলেছিলেন ডা. মহলানবিশ। জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটিতে তখন তিনি গবেষণা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহায্য নিয়েই তিনি তাঁর থিওরি প্রয়োগ করেন। এক লিটার জলে ২২ গ্রাম গ্লুকোজ, ৩.৫ গ্রাম সোডিয়াম ক্লোরাইড (খাওয়ার নুন) ও ২.৫ গ্রাম সোডিয়াম বাইকার্বোনেট বা বেকিং সোডা মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরি করেন। এই মিশ্রণ খাওয়াতে শুরু করেন রোগীদের। তাঁর তৈরি সলুউশন কাজ করবে কিনা, সে নিয়ে চিন্তাও ছিল তাঁর। কিন্তু দেখলেন লাগাতার সেই মিশ্রণ খেতে খেতে মুমূর্ষু রোগীরা চোখ মেললেন। বমি-পায়খানা কমতে শুরু করল অনেকের। ডা. মহলানবিশ এই মিশ্রণের নাম দিলেন ওরাল রিহাইড্রেশন সল্ট বা ওআরএস।
হাতে চাঁদ পেলেন বিজ্ঞানী। ছুটলেন বড়বাজার। বস্তা বস্তা নুন, চিনি, বেকিং সোডা কেনা হল। তৈরি হল মিশ্রণ। তাই খেয়েই প্রাণে বাঁচলেন রোগীরা। এতদিন রিহাইড্রেশন থেরাপি সূঁচ ফুটিয়ে বা ইনট্রাভেনাস উপায়ে করা হত, সেই প্রথমবার ওরাল থেরাপি বা খাবার ওষুধ হিসেবে এই থেরাপিকে পরিচিতি দিলেন তিনি। ১৯৭৩ সালে জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির মেডিক্যাল জার্নালে ওআরএস থেরাপির কথা লেখা হয়। বিশ্বের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মেডিক্যাল জার্নাল ‘দ্য ল্যানসেট’ এই গবেষণাকে স্বীকৃতি দেয়। ডা. মহলানবিশের গবেষণার খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) স্বীকৃতি দেয় এই আবিষ্কারকে।
এর পরে বিশ্বের প্রায় ১০৫টি দেশে ডায়ারিয়া ও ডিহাইড্রেশনের জীবনদায়ী ওষুধ হিসেবে ওআরএসকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপুঞ্জে রিফিউজি ক্যাম্পে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিল ডা. দিলীপ মহলানবিশের ওআরএস।
চিকিৎসাশাস্ত্রে অসামান্য অবদানের জন্য পোল্লিন ও মাহিডোল পুরস্কার পেলেও, নোবেল অধরাই থেকে গিয়েছিল এই বাঙালি বিজ্ঞানীর। সে জন্য অবশ্য আফশোসও ছিল না তাঁর। সারাজীবন প্রচারের আড়ালেই কাটিয়েছেন। ১৯৯০ সাল অবধি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডায়েরিয়া ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের মেডিক্যাল অফিসার ছিলেন তিনি। ১৯৯৪ সালে রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের সদস্যও ছিলেন। পার্ক সার্কাসে ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথের সদস্য হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন শেষ বয়স অবধি। নিজের সারা জীবনের উপার্জন এক কোটি টাকা এই ইনস্টিটিউটেই বাচ্চাদের জন্য দান করে গেছেন তিনি।