
৫০ পেরিয়েও মা হওয়া যায়? কীভাবে সম্ভব? সত্তরে সন্তানের জন্ম দিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন এঁরা
গুড হেলথ ডেস্ক
নারী ও মাতৃত্ব মনে হয় একে অপরের পরিপূরক। নারীসত্তার পূর্ণতা আসে মাতৃত্বে। সেই ঔরসজাত সন্তানই হোক আর দত্তক নেওয়া সন্তান। বয়স, শারীরিক জটিলতা সব কিছুই সেখানে তুচ্ছ। নিজের গর্ভে সন্তানধারণ করে মাতৃত্বের স্বাদ পেতে চান অনেকেই। তার জন্য বয়স, শারীরিক জটিলতা, সমাজ-সংস্কার, চক্ষুলজ্জার ভয় সবকিছুই ত্যাগ করা যায়। শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেই মাতৃত্বকে সাদরে বরণ করে নিয়েছিলেন এই দেশেরই অনেক নারী। কারও পঞ্চাশ পেরিয়েছে, কেউ সত্তরের বৃদ্ধা (Aging and Pregnancy)। ওই বয়সেই সুস্থ সন্তানের জন্ম দিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন এঁরা।
সম্প্রতি একটি খবর সামনে এসেছে। উত্তর চব্বিশ পরগনার এক দম্পতি বেশি বয়সে মা-বাবা হয়েছে। সত্তরের বৃদ্ধর ৫৪ বছরের স্ত্রী ফুটফুটে যমজ সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। ২০১৯ সালে ট্রেন দুর্ঘটনায় একমাত্র ছেলের মৃত্য়ুর পরে ভেঙে পড়েছিলেন তাঁরা। চূড়ান্ত মানসিক যন্ত্রণা আর একাকীত্ব কাটিয়ে উঠতে তাঁরা এই বয়সেই সন্তানের জন্ম দেওয়ার কথা ভাবেন। নানা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে, বাধার পাহার ডিঙিয়ে সুস্থ সন্তানের জন্ম দিয়েছেন প্রৌঢ়া (Aging and Pregnancy)।
বাবার বয়স ৭০ আর মায়ের ৫৪, কোলে এল যমজ ছেলে-মেয়ে! আনন্দে ভাসছেন সন্তান হারানো দম্পতি
আমাদের দেশে বেশি বয়সে সন্তানের জন্ম (Aging and Pregnancy) দেওয়ার ঘটনা নতুন নয়। আইভিএফ পদ্ধতির সাহায্য নিয়ে ২০০৮ সালে ৬৯ বছর বয়সে কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়ে নজির গড়েছিলেন হিসারের প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা রাজো দেবী লোহান। ২০১৬ সালে যখন ছেলের জন্ম দেন দলজিন্দর তখন তাঁর বয়স ৭২, স্বামীর ৭৯। এই ঘটনা গোটা দেশেই তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল। নানা জটিলতার কারণে ৪৬ বছরের দাম্পত্য জীবনে সন্তানের জন্ম দিতে পারেননি তিনি। শেষে আইভিএফের দ্বারস্থ হয়ে ৭২ বছর বয়সে সুস্থ সন্তানের জন্ম দেন তিনি। উত্তর প্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা ৭০ বছরের ওমকারি পানওয়ার ও তাঁর স্বামী নিজেদের সব সঞ্চয় দিয়ে ফার্টিলিটি ট্রিটমেন্টের পর একটি ছেলে ও একটি মেয়ের জন্ম দেন।
এর থেকেই প্রশ্ন আছে, এত বেশি বয়সে সন্তানের জন্ম দেওয়া কীভাবে সম্ভব? একটা সময় ছিল যখন ভাবা হত, কুড়ির কোঠাই মাতৃত্বের জন্য সেরা সময়। ধীরে ধীরে সে পরিধি বড় হয়েছে। কেরিয়ার, চাকরি সব সামলে মা হওয়ার বয়স স্বাভাবিক ভাবেই পিছিয়েছে। তিরিশ, মধ্য তিরিশেও যে মা হতে বাধা নেই, মহিলারা তা বুঝেছেন। এখন অবশ্য বহু মহিলাই চল্লিশ বছর বয়সে বা তার পরেও মা হচ্ছেন। করিনা কাপুর, নন্দিতা দাস এঁরা চল্লিশ পেরিয়ে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। কাজেই ৩০-৪০ বছর অবধি স্বাভাবিকভাবে সন্তানের জন্ম দেওয়া সম্ভব, যদি না মেনোপজ দেরিতে আসে। তাছাড়া কিছু থেরাপিও থাকে। উত্তর চব্বিশ পরগনার যে মহিলা মা হয়েছেন তাঁর বয়স ৫৪ বছর, সত্তর পেরিয়ে মা হয়েছেন যাঁরা তাঁদের মেনোপজের সময়সীমা পেরিয়ে গিয়েছিল বহু বছর আগেই। এর পরেও গর্ভধারণে প্রতিবন্ধকতা আসেনি। আধুনিক চিকিৎসায় সবটাই সম্ভব বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারবাবুরা।
৩৫ মাতৃত্বের ডেডলাইন কেন?
তবে চাইলেন আর মা হয়ে গেলেন, ব্যাপারটা কিন্তু অত সহজ নয়। কারণ বয়স যত বাড়বে মেয়েদের ডিম্বাশয়ে জটিলতা তত বাড়বে। ডিম্বাণুর সংখ্যা ও গুণমানও কমতে থাকবে। ৩৫-এর পর প্রেগন্যান্সির সম্ভাবনা দ্রুত কমে যেতে থাকে। চল্লিশে যদিও প্রেগন্যান্সি আসে তাহলেও হরমোনের গোলমালের জন্য মিসক্যারেজ বা গর্ভপাতের সম্ভাবনা বাড়ে। আবার ডিম্বাণুর গুণমান ভাল না হলে বাচ্চা বিকলাঙ্গ হতে পারে। বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে মায়ের স্বাস্থ্যও। সে ক্ষেত্রেও প্রেগন্যান্সিও জটিল হয়ে পড়ে। তাই তিরিশের আগেই মা হওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। আর ৩৫ হল মাতৃত্বের ডেডলাইন। চল্লিশ এবং তার বেশি হয়ে গেলেই সেটা হাই রিস্ক প্রেগন্যান্সি। এই বয়সে নর্মাল ডেলিভারি হলে পরবর্তীতে মল ধরে রাখতে অসুবিধে, পেলভিক ফ্লোরে উইকনেসের মতো সমস্যা হতে পারে।
বেশি বয়সে মাতৃত্ব কীভাবে সম্ভব? অনেকগুলো উপায় আছে
ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (আইভিএফ/IVF) পদ্ধতির সাহায্য নেন ডাক্তাররা। ভিট্রো কথাটির অর্থ শরীরের বাইরে। এই পদ্ধতিতে শরীরের বাইরে জীবন সৃষ্টি করা হয় বলে পদ্ধতিটিকে ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন বলে। চলতি কথায়, টেস্ট টিউব বেবি। ডিম্বানু আর শুক্রাণুর নিষেক ঘটানো হয় শরীরের বাইরে ল্যাবরেটরিতে। ভ্রূণ তৈরির পরে তা ইনকিউবেটরে রাখা হয়। ২-৫ দিন পরে ভ্রূণ প্রতিস্থাপন করা হয় মায়ের জরায়ুতে।
এর বাইরে এগ ডোনেশন পদ্ধতিতেও মা হওয়া সম্ভব। ধরুন ৬০ বছরের মহিলা মা হতে চাইছেন। তাঁর জরায়ুর ধারনক্ষমতা থাকলেও ডিম্বানু তৈরি হওয়া বন্ধ হয়েছে প্রাকৃতিক উপায়েই। কাজেই সেই মহিলা যদি নিজের গর্ভজাত সন্তান চান, তাহলে কারও থেকে ডিম্বানু ধার নিতে হবে। ২৫ বা ৩০ বছরের মহিলার ডিম্বানুর সঙ্গে স্বামীর শুক্রাণু নিষেক ঘটিয়ে সন্তানের জন্ম দেওয়া যায়। এতে ডোনারের ডিম্বাণু নেওয়া হয়। তার সঙ্গে শুক্রাণুর মিলন ঘটিয়ে ভ্রূণ গর্ভে রোপণ করা হয়। এতে বাবার শুক্রাণু নেওয়া হচ্ছে। আর মা-ই বাচ্চাকে গর্ভে ধারণ করছেন। মা’র রক্ত-মাংসে সন্তান বড় হচ্ছে। সুতরাং দু’জনের ভূমিকাই থাকছে। তা ছাড়া সুবিধে হল কমবয়সি মহিলাদের থেকে ডিম্বাণু নেওয়ায় গুণমান ভাল হয়। গর্ভপাত ও বিকলাঙ্গ সন্তানের সম্ভাবনা কমে।
চল্লিশের পরে অনেকেই মা হন চিকিৎসার পরে। ওভুলেশন ইনডাকশন বা ফলিকিউলোমেট্রির পরে সন্তান হয় বলে যমজ সন্তান হতে পারে। চিকিৎসা করে বাচ্চা নিলে অনেক সময়ে টুইন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। কিন্তু স্বাভাবিক ভাবে মা হলে সে সম্ভাবনা থাকে না।
যদি নিজের ডিম্বানু থেকে সন্তানের জন্ম দিতে চান, কিন্তু বয়স প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়, সেক্ষেত্রে ডিম্বানু সংরক্ষণ বা উসাইট প্রিজার্ভেশন বা এগ ফ্রিজিং-এর সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। ‘উসাইট ফ্রিজিং’ এমন এক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি যার মাধ্যমে ডিম্বানু ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ করে রাখা যায়। খুব কম সাব-জিরো তাপমাত্রায় এই সংরক্ষণ করা হয়, তাই একে ক্রায়োপ্রিজার্ভেশন বলে। কোনওরকম শারীরিক সমস্যা বা ম্যালিগন্যান্সি থাকলে বা মা হওয়ার বয়স পেরিয়ে গেলে, এগ ফ্রিজিং অন্য়তম উপায় হতে পারে। তাই আগে থেকে ডিম্বানু সংরক্ষণ করে রাখলে ভবিষ্যতে মা হওয়ার কোনও সমস্যা থাকে না। তাছাড়া অনেক মহিলারই পরিবারে সময়ের আগে মেনোপজ হয়ে যাওয়ার ইতিহাস থাকে। সেক্ষেত্রে যদি বেশি বয়সে মা হওয়ার ভাবনা থাকে, তাহলে আগে থেকেই ডিম্বানু সংরক্ষণের কথা ভাবা যেতে পারে। আর জরুরি কারণে এগ ফ্রিজিং করা হয় যদি দেখা যায় স্বামীর স্পার্ম কাউন্ট ঠিক নেই, শুক্রাণু পাওয়া যাচ্ছে না, তখন উসাইট সংরক্ষণের কথা ভাবা হয়।
কীভাবে সংরক্ষণ করা হয় ডিম্বানু? শরীর থেকে যে পদ্ধতিতে ডিম্বানু বের করা হয় তাকে বলে ট্রান্সভ্যাজাইনাল উসাইট রিট্রিভাল। ডিম্বানুকে তরল নাইট্রোজেনে -১৯৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়। তার আগে ডিম্বানুর মধ্যে যে জলের পরিমাণ থাকে তা বের করে নেওয়া হয়। কারণ ক্রায়োপ্রিজার্ভেশনের সময় অতিরিক্ত জল থাকলে তাতে ক্রিস্টাল তৈরি হয়ে যায়। -৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পৌঁছলেই দেখা যায় ক্রিস্টাল তৈরি হতে শুরু করেছে, তখন ডিম্বানুর আকার ও গুণগত মান নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। তাই ভিট্রিফিকেশন পদ্ধতিতে জল বের করে ফেলা হয়। ডিএমএসও নামে একধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করে ডিম্বানুকে -১৯৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং সংরক্ষণ করা হয়। এই হিমশীতল তাপমাত্রায় যতদিন খুশি ডিম্বানু সংরক্ষণ করে রাখা যায়।
মা হতে চাইলে এই ডিম্বানু তরল নাইট্রোজেন থেকে বের করে স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর সেই ডিম্বানুতে ইন্ট্রা-সাইটোপ্লাজমিক স্পার্ম ইঞ্জেকশন করা হয়। ইকসি (ইন্ট্রা সাইটোপ্লাজমিক স্পার্ম ইঞ্জেকশন) পদ্ধতিতেও স্পার্ম ইনজেক্ট করা যেতে পারে, আরও নানা পদ্ধতি আছে। শুক্রাণু ও ডিম্বানুর মিলন ঘটিয়ে ভ্রূণ বা এমব্রায়ো তৈরি করে ফের তরল নাইট্রোজেনে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। সঠিক সময় তা তরল নাইট্রোজেন থেকে বের করে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ফিরিয়ে এনে জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়।
তবে বেশি বয়সে মা হতে গেলে কয়েকটা জিনিস মাথায় রাখতেই হবে।
বেশি বয়সে গর্ভধারণ করতে হলে কী কী খেয়াল রাখতেই হবে?
হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস ও থাইরয়েড—এই তিনটির যে কোনও একটি থাকলেই আগে ডাক্তার দেখিয়ে নিতে হবে। এগুলির কোনও একটি থাকলে সন্তানের ওপর প্রভাব পড়তে পারে।
যদি মৃগী রোগ থাকে তাহলে মা হওয়া যাবে কিনা সেটা জেনে নিতে হবে।
মায়ের ভেনাস থ্রম্বোসিস (রক্ত জমাট বাঁধা), জেস্টেশনাল ডায়াবিটিস থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ দরকার। সেক্ষেত্রে সদ্যজাতর ক্ষেত্রে যে সমস্যাগুলো হতে পারে তা হল, প্রিম্যাচিয়োর বার্থ, ডাউন সিনড্রোম, লো বার্থ ওয়েট ইত্যাদি।
থ্যালাসেমিয়া টেস্ট করিয়ে নেওয়া ভাল। রুবেলা ইমিউনিটি না থাকলে তার ভ্যাকসিনও দেওয়া হয়।
বয়স ৩৯ পার করে গেলেই সেই মহিলার রক্তের এনআইপিটি টেস্ট করে নেওয়া হয়। তাতেই ৯৯ শতাংশ বলে দেওয়া যায় বাচ্চার ডাউন সিন্ড্রোম হতে পারে কিনা।
নিজে সুস্থ থাকলেই সুস্থ সন্তানের জন্ম দেওয়া যায়। তাই বেশি বয়সে সন্তানধারণে কোনও ভয় বা লজ্জার কারণ নেই।