
গর্ভস্থ যমজ শিশুর প্রাণ বাঁচল, পূর্ব ভারতে প্রথম ইন্টারস্টিশিয়াল লেজার থেরাপিতে নজির অ্যাপোলোর
দ্য ওয়াল ব্যুরো: গর্ভস্থ যমজ শিশুর একটি যদি রুগ্ন, অপুষ্ট হয়ে পড়ে এবং অন্যটি অধিক পুষ্টি পেতে থাকে, তাহলে দুই শিশুরই প্রাণ সংশয় হতে পারে। সেক্ষেত্রে একটি শিশুকে বাঁচাতে পারেন ডাক্তাররা। তবে এক্ষেত্রে যে ধরনের অস্ত্রোপচারের দরকার হয় তা অত্যন্ত জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ। সামান্য ভুলেই প্রাণ সংশয় হতে পারে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে ইন্টারস্টিশিয়াল লেজার থেরাপি (Interstitial Laser Therapy) নামে একধরনের সার্জারি আছে যার সাহায্যে এই জটিল অস্ত্রোপচার সহজে করা যায়। গর্ভস্থ শিশুর প্রাণও বাঁচে। কলকাতার অ্যাপোলো মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতাল এই ধরনের সার্জারিতে ইতিহাস তৈরি করল।
পূর্ব ভারতে প্রথম ইন্টারস্টিশিয়াল লেজার থেরাপিতে নজির গড়ল কলকাতার অ্যাপোলো হাসপাতাল। মায়ের গর্ভে একটি শিশুকে নতুন প্রাণ দিলেন ডাক্তারবাবুরা।
যমজ শিশুদের ক্ষেত্রে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে?
আজকাল বেশি বয়সে সন্তানধারণের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন অনেক মহিলাই। আইভিএফ পদ্ধতিতে গর্ভধারণ অনেক বেশি হচ্ছে। যমজ সন্তানের সংখ্যাও বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। সমীক্ষা বলছে, এখন প্রতি ৫০ জন গর্ভবতী মহিলার একজনের গর্ভে যমজ সন্তান জন্ম নিচ্ছে। ডাক্তারবাবুরা বলছেন, যমজ সন্তানের ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় অনেকরকম ঝুঁকি থাকে।
কী সেই ঝুঁকি? যমজ গর্ভাবস্থার ৬৬ শতাংশ হল ডাইকোরিয়োনিক, অর্থাৎ মায়ের গর্ভে ২টি পৃথক ডিম্বাণু এবং শুক্রাণু থেকে ভ্রূণগুলি তৈরি হয় এবং জরায়ুর মধ্যে আলাদা আলাদা প্রকোষ্ঠে পৃথক রক্তপ্রবাহে পুষ্ট হয়ে বেড়ে ওঠে। বাকি ৩৩ শতাংশ মনোকোরিয়োনিক, অর্থাৎ গর্ভে ১টি ডিম্বাণু এবং ১টি শুক্রাণু থেকেই ভ্রূণগুলি তৈরি হয় এবং জরায়ুর মধ্যে একই প্রকোষ্ঠে একই রক্তপ্রবাহে পুষ্ট হয়ে বেড়ে উঠতে থাকে।
এই মনোকোরিয়ানিক গর্ভাবস্থায় এক ধরনের ক্রস (সিলেক্টিভ) ইন্ট্রাইউটেরাইন গ্রোথ রেস্ট্রিকশনের সম্ভাবনা থাকে, যাকে ডাক্তারি ভাষায় বলে টুইন-টু-টুইন-ট্রান্সফিউশন সিনড্রোম (TTTS)। এর কারণেই অনেকসময় গর্ভে যমজ শিশুর মৃত্যু হয়। ১০-১৫% মনোকোরিয়োনিক যমজ গর্ভাবস্থায় একটি শিশুর বৃদ্ধি বেশি হয় ও অন্যটিরে একেবারেই কম হয়। এরকম হওয়ার কারণ হল একই প্লাসেন্টা থেকে দুজনের জন্য রক্ত প্রবাহিত হওয়ার ফলে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়। একটি ভ্রূণ তথাকথিত দাতা এবং অন্যটি গ্রহীতায় পরিণত হয়। দাতা বা ডোনার ভ্রূণ থেকে পুষ্টিরস বেরিয়ে গ্রহীতার শরীরে চলে যায়, ফলে দাতা ভ্রূণ অপুষ্ট হতে থাকে ও অন্যটি বেশি পুষ্টি পেতে শুরু করে। দুর্বল শিশুটির মধ্যে পুষ্টির অভাবের ফলে কোনও ক্লট বা কার্ডিয়াক ত্রুটি থাকে, তাহলে সেই সমস্যা প্লাসেন্টার মধ্যে দিয়ে সুস্থ শিশুটির শরীরেও চলে যায়। ফলে জরায়ুতে দুর্বল শিশুটির মৃত্যুর ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই সুস্থ শিশুটিরও মৃত্যু হয়।
অ্যাপোলো হাসপাতালে হওয়া থেরাপির ক্ষেত্রে এই সমস্যাটি ধরা পড়েছিল মা গর্ভবতী হওয়ার ১৪তম সপ্তাহে। তখন গর্ভের মধ্যে দুটি শিশুরই যথাযথ বৃদ্ধি নিশ্চিত করে দুজনকেই বাঁচানো অসম্ভব। একটি শিশুকে ওই থেরাপির সাহায্যে প্রাণ দিয়েছেন ডাক্তাররা।
কীভাবে হয় এই থেরাপি?
অ্যাপোলো হাসপাতালের ডাক্তাররা ডায়োড লেজার ব্যবহার করে থেরাপি করেন। ইন্টারস্টিশিয়াল ডায়োড লেজার থেরাপিতে একটি সূক্ষ্ম সূঁচ মায়ের জরায়ুতে প্রবেশ করানো হয়। তা থেকে কিছু লেজার বিম বেরিয়ে রুগ্ন শিশুটির শরীরে প্রবেশ করে, ফলে তার মৃত্যু হয়। এমন করা হয় যাতে সুস্থ শিশুটিকে বাঁচানো যায়।
ভ্রূণ ও প্লাসেন্টা দেখার জন্য আল্ট্রা সাউন্ডের সাহায্য নেওয়া হয়। লেজার থেরাপিতে দুর্বল দাতা ও বেশি পুষ্ট শিশুটির মাঝের ধমনীগুলি কেটে দেওয়া হয়। ফলে পুষ্টির এই আদানপ্রদান বন্ধ হয়ে যায়। সুস্থ শিশুটি স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পেতে থাকে।
অ্যাপোলো মাল্টিস্পেশালটি হসপিটালের ডিরেক্টর ও এইচওডি অবস্টেট্রিক্স অ্যান্ড গায়নকোলজি, ডাঃ জয়ন্ত কুমার গুপ্ত বলেছেন, “বাবা-মায়েদের পক্ষে জন্মের আগেই যমজদের একজনকে ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া সত্যিই খুব শক্ত। কিন্তু দুজনের একজনকে বাঁচানোর এটাই একমাত্র পদ্ধতি। না হলে দুজনেই মারা যাবে। অ্যাপোলোতে আমরা পূর্ব ভারতে এই প্রথম ইন্টারস্টিশিয়াল লেসার থেরাপি করলাম, যাতে যমজদের একজনকে অন্তত বাঁচানো যায়। টুইন-টু-টুইন-ট্রান্সফিউশন সিনড্রোমের (TTTS) একটা কেসে এই চিকিৎসা প্রয়োগ করা হল।“ ডাক্তারবাবু বলছেন, এই সমস্যা কেবল আইডেন্টিকাল টুইনদেরই হয়, কারণ তারা একই প্লাসেন্টা থেকে পুষ্টি পায়। টুইন-টু-টুইন-ট্রান্সফিউশন সিনড্রোমে আক্রান্ত আরও গর্ভবতী মহিলাদের জন্য এই থেরাপির প্রয়োগ সফল হবে বলেই মনে করছেন তিনি।