
থ্যালাসেমিয়া রোধে সচেতন হোক নয়া প্রজন্ম
সঞ্জীব আচার্য
কর্ণধার সিরাম অ্যানালিসিস
থ্যালাসেমিয়া (Thalassemia) রোগটা কি ছোঁয়াচে? থ্যালাসেমিয়া রোগীর কি মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী? এমন নানা প্রশ্ন উঠে আসে। থ্যালাসেমিয়া রোগের সঙ্গে আতঙ্ক যতটা জড়িয়ে ততটাই মিশে আছে অসচেতনতা। এই রোগ কীভাবে হয়, কীভাবে একে রোখা যায়, কতটা সচেতন হতে হবে, এইসব প্রশ্ন সেই তিমিরেই। এখনও সচেতনতার অভাবে থ্যালাসেমিয়া রোগীকে অবজ্ঞা করা হয়। স্কুল-কলেজ, অফিস বা যে কোনও কর্মস্থলে থ্যালাসেমিয়া রোগীকে অছ্যুত করে রাখার প্রবৃত্তি দেখা যায়। অথচ সচেতন হলেই থ্যালাসেমিয়া নির্মূল করা সম্ভব। বর্তমান প্রজন্মকে এর জন্য সচেতন হতে হবে।
কেন হয় থ্যালাসেমিয়া?
থ্যালাসেমিয়া এক ধরনের রক্তের অসুখ। ডাক্তারি ভাষায় বলে ব্লাড ডিজঅর্ডার। এটি জিনগত রোগ। বংশপরম্পরায় শিশুর শরীরে চলে আসে। এই রোগের ফলে শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমতে থাকে। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের রক্তে লোহিত রক্তকণিকা ও হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ মারাত্মকভাবে কমে যায়। রক্তাল্পতার সমস্যা দেখা দেয় রোগীর। যদি মা ও বাবা দুজনেই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হন, তাহলে সন্তানের শরীরে এই রোগ চলে আসতে পারে। তবে থ্যালাসেমিয়া কোনওভাবেই ছোঁয়াচে রোগ নয়।
থ্যালাসেমিয়া দু’ধরনের হয়—আলফা ও বিটা। আলফা থ্যালাসেমিয়ায় রোগের লক্ষণ মৃদু বা মাঝারি। বিটা থ্যালাসেমিয়ার তীব্রতা অনেক বেশি। বাবা-মায়ের থেকে প্রাপ্ত চারটি জিনের মধ্যে এক বা একাধিক জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে আলফা থ্যালাসেমিয়া হয়। জিন যত ত্রুটিপূর্ণ হবে, সমস্যা তত বাড়বে। চারটি জিনেই যদি ত্রুটি থাকে তাহলে আলফা থ্যালাসেমিয়ার তীব্রতা বাড়বে, তখন তাকে বলা হবে আলফা থ্যালাসেমিয়া মেজর বা হাইড্রপস ফিটালিস।
বিটা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের থেকে আসা দুটি জিনই ত্রুটিপূর্ণ হয়। যদি একটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হয় তাহলে কিছুটা কম উপসর্গ দেখা যায়। একে বলা হয় বিটা থ্যালাসেমিয়া মাইনর। যদি দু’টি জিন ত্রুটিপূর্ণ হয়, তাহলে মাঝারি থেকে মারাত্মক উপসর্গ দেখা যায়। একে বলে বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর।
কী কী লক্ষণ দেখে সতর্ক হতে হবে
প্রচণ্ড ক্লান্তি দেখা দেবে। ত্বক হবে ফ্যাকাশে। নানা রকম সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়বে। হার্টের সমস্যা দেখা দেবে। হাড় ভঙ্গুর হতে শুরু করবে। শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হবে। মুখের হাড়ে বিকৃতি দেখা দিতে পারে, মূত্রের রঙ গাঢ় হবে।
রোগ নির্ণয় হবে কী করে
থ্যালাসেমিয়া রোগ নির্ণয়ের জন্য হাই পাওয়ার লিকুইড ক্রোমাটোগ্রাফি (এইচপিএলসি) পরীক্ষা করা দরকার। হাত ও মাথার এক্স-রেও করা হয়।
থ্যালাসেমিয়া রোগীদের ব্লাড ট্রান্সফিউশন বা রক্ত বদলানো জরুরি। শিশুর জন্মের প্রথম ৬ মাসের মধ্যে সুপার ট্রান্সফিউশন প্রোগ্রাম করা হয়, পূর্ণবয়স্কদের জন্য করা হয় হাইপার ট্রান্সফিউশন। রোগীর শরীরে হিমোগ্লোবিনের লেভেল ধরে রাখার জন্য ট্রান্সফিউশন করা জরুরি।
অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন বা বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন কার্যকর চিকিৎসা। তবে এই চিকিৎসা পদ্ধতি অনেক জটিল এবং খরচসাপেক্ষ।
অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্লীহা ও গল ব্লাডার বাদ দিয়েও ট্রিটমেন্ট করা হয়।
থ্যালাসেমিয়া রোধে সার্বিক সচেতনতা দরকার
এই রোগকে বিদায় করতে হলে থ্যালাসেমিয়া বাহকের সঙ্গে যাতে কোনও ভাবেই আরেক জন বাহকের বিয়ে না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। সে জন্য স্কুল ও কলেজ স্তরের ছাত্রছাত্রীদের রক্তে থ্যালাসেমিয়ার বাহক রয়েছে কি না, তা জানা দরকার।
সচেতনতার মূলত দু’টি দিক। বিয়ের আগে পাত্র এবং পাত্রী— দু’জনেই থ্যালাসেমিয়া বাহক কি না, তা পরীক্ষা করা জরুরি। একই সঙ্গে দু’জনের মধ্যে এক জন যদি থ্যালাসেমিয়া বাহক না হন, তাহলে সুস্থ দাম্পত্য জীবন এবং সন্তানধারণে যে কোনও সমস্যা নেই তা প্রচার করা দরকার।
বিয়ের রেজিস্ট্রির সময়ে থ্যালাসেমিয়া ক্যারিয়ার টেস্টের সার্টিফিকেট জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা উচিত।
যদি দু’জন থ্যালাসেমিয়ার বাহকের বিয়ে হয়েও যায়, সে ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় ভ্রুণের রক্ত পরীক্ষা করানো সবচেয়ে আগে দরকার। স্বামী ও স্ত্রী দু’জনেই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে গর্ভাবস্থায় ৮ থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে ভ্রূণের পরীক্ষা করানো দরকার।
যদি কোন পরিবারের এক জন থ্যালাসেমিয়া বাহক হন তা হলে পরিবারের সকলেই রক্তপরীক্ষা করান।
গর্ভস্থ সন্তান থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত কি না, জানার জন্য কোরিয়োনিক ভিলাস স্যাম্পলিং, অ্যামনিওসেনটেসিস, ফিটাল ব্লাড স্যাম্পলি, এই পরীক্ষাগুলি করা প্রয়োজন।
থ্যালাসেমিয়া রোগীকে অবহেলা নয়, বরং সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত।