ডেঙ্গি ভাইরাস কোষ থেকে জল শুষে নিচ্ছে, রোগ কখন মারাত্মক হবে, কী চিকিৎসা জরুরি, বললেন ডাক্তারবাবু

গুড হেলথ ডেস্ক

কোভিডের পরে যে রোগ নিয়ে চিন্তার ভাঁজ চওড়া হচ্ছে, তা হল ডেঙ্গি। দেশজুড়েই ডেঙ্গির প্রকোপ প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গেও ডেঙ্গির (Dengue) পজিটিভিটি রেট বাড়ছে। জেলায় জেলায় ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যু। একটা সময় ডেঙ্গি হলেও সেরে যেত, কিন্তু ইদানীংকালে ডেঙ্গি জ্বর প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে। মারাত্মক ডিহাইড্রেশন, পেটের অসুখ, বমি, মাথা ঘোরার মতো উপসর্গও দেখা দিচ্ছে। 

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাই বলছেন ডেঙ্গি ভাইরাস তার চরিত্র বদল করেছে। জেনেটিক মিউটেশন হচ্ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই সময় জ্বর হলে তা  ডেঙ্গি কিনা বোঝা যাবে কী করে, ভয়ের কারণ কতটা, রোগ ধরা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে কী ব্যবস্থা নিতে হবে, কী ধরনের চিকিৎসা জরুরি সবকিছুই বিস্তারিত বললেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ (সিনিয়র পাবলিক হেলথ স্পেশালিস্ট) ডাক্তার সুবর্ণ গোস্বামী।

কেন এত মারাত্মক হয়ে উঠেছে ডেঙ্গি?

ডাক্তার সুবর্ণ গোস্বামী বলছেন, ডেঙ্গি (Dengue) যদি প্রথমবার হয় তাহলে চিন্তার কারণ অতটা থাকে না। কিন্তু দ্বিতীয়বারও যদি ডেঙ্গি ধরা পড়ে তখন চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আগে ডেঙ্গি হলেও তা নিয়ে এতটা উদ্বেগ ছিল না। ডেঙ্গি হত, আবার সেরেও যেত। কিন্তু এই সময় ডেঙ্গি জ্বর কোভিডের মতোই আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছে। ডেঙ্গি আক্রান্তদের নানারকম শারীরিক জটিলতা দেখা দিচ্ছে। এর কয়েকটি কারণ রয়েছে।

 Dengue Fever

কী কী সেই কারণ?

১) ডেঙ্গির (Dengue) কারণ হল ডেঙ্গি ভাইরাস। স্ত্রী এডিস ইজিপ্টাই (aedes aegypti) মশা এই ভাইরাসদের বাহক। ডেঙ্গি ভাইরাসের চার রকম সেরোটাইপ রয়েছে–ডেনভি-১, ডেনভি-২, ডেনভি-৩ ও ডেনভি-৪।  এই চার সেরোটাইপের মধ্যে আগে ডেনভি-২ ভাইরাসের সংক্রমণই বেশি হত। কিন্তু এখন ডেনভি-৩ ভাইরাসের উপদ্রব বেড়েছে। ডেনভি-৩ সেরোটাইপ আরও বেশি সংক্রামক। তাই রোগের জটিলতাও বেশি হয়।

২) ধরুন, কারও প্রথমবার ডেনভি-২ ভাইরাসের সংক্রমণ হল। দ্বিতীয়বারও সেই ব্যক্তির ডেঙ্গি ধরা পড়ল এবং সেইবার ডেনভি-৩ সেরোটাইপের সংক্রমণ হল। তাহলে রোগ জটিল পর্যায়ে যেতে পারে। 

৩) করোনা পরবর্তী সময়ে অনেকেরই নানারকম শারীরিক সমস্যা বেড়েছে। একবার বা দু’বার কোভিড হয়ে গেছে এমন রোগীর সংখ্যাও অনেক। তাই তাদের যদি ডেঙ্গি হয়, সেক্ষেত্রে রোগের জটিলতা বাড়তে পারে। 

৪) কোনওরকম কোমর্বিডিটি থাকলে ডেঙ্গি মারাত্মক আকার নিতে পারে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকলে সমস্যা বাড়তে পারে।

৫) করোনার সঙ্গেই যদি ডেঙ্গি ধরা পড়ে এবং ডেনভি-৩ ভাইরাসের সংক্রমণ হয়, সেক্ষেত্রে রোগীর ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। 

ডেঙ্গি (Dengue) ও করোনা দুইই আরএনএ ভাইরাস। করোনা যেমন ছোঁয়াচে, একজনের থেকে অন্যজনের হতে পারে, ডেঙ্গি তেমন নয়। তবে ডেঙ্গু ভাইরাস শরীরে ঢুকলে খুব তাড়াতাড়ি বংশবৃদ্ধি করে রোগ ছড়াতে পারে। তখন জটিল অবস্থা তৈরি হবে, বিপদ বাড়বে।

BEWARE OF THIS FAST KILLING DISEASE(DENGUE FEVER) — SteemitCureus | A Case of Dengue Fever With Hemorrhagic Manifestations

কোন কোন লক্ষণ দেখে বুঝতে হবে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা প্রয়োজন

জ্বর যদি সাতদিনেও না সারে, তাহলে টেস্ট করিয়ে নিতে হবে

খুব দুর্বলতা, বার বার বমি হবে

পেটে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট হতে পারে

ডিহাইড্রেশন, ডায়ারিয়া, খেতে না পারা

মাথা ঘুরবে, দাঁড়াতেই পারবে না রোগী

শরীরের কোথাও থেকে রক্ত বের হচ্ছে (দাঁত, মাড়ি, মলদ্বার, নাক-মুখ)

শরীরের কোষ থেকে জল শুষে নিচ্ছে ভাইরাস, স্যালাইট ট্রিটমেন্ট জরুরি

ডাক্তারবাবু বলছেন, প্লেটলেট কমে যাওয়া থেকেও বড় চিন্তার কারণ হল ডিহাইড্রেশন। ডেঙ্গি (Dengue) ভাইরাস বহনকারী মশা মানুষকে কামড়ালে লালার মধ্যে থাকা ভাইরাসরা চট করে ঢুকে যায় মানুষের রক্তে। সরাসরি ঢুকে পড়ে শ্বেত রক্তকোষে। তারপর সেই কোষগুলি যখন শরীরের ভিতর ঘুরেফিরে বেড়ায় তখন সেগুলির ভিতরে এই ভাইরাস প্রজনন চালিয়ে যায়। সংখ্যায় বাড়তে থাকে। ডেঙ্গি ভাইরাস শরীরে ঢুকে সবচেয়ে আগে কোষগুলি থেকে জল শুষে নিতে শুরু করে। ফলে শরীর জলশূন্য হতে থাকে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এমনিতেই ভেঙে পড়ে।

ডেঙ্গির ক্ষেত্রে তাই সবচেয়ে বড় চিন্তা হল ডিহাইড্রেশন। লক্ষণ বুঝলেই তাই সঙ্গে সঙ্গে স্যালাইন ট্রিটমেন্ট শুরু করে দেওয়া জরুরি।  ডেঙ্গিতে প্লেটলেট কমলেও তা আবার সময়মতো বেড়ে যায়। যদি ডেঙ্গিতে খুব বেশি জটিলতা না হয়, তাহলে জ্বর কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্লেটলেট বাড়তে শুরু করে। যদি প্লেটলেট ৩০ হাজারে নেমে আসে তখন চিন্তা বাড়ে। এর পর থেকে রোগীর শরীর বুঝে প্লেটলেট দেওয়া শুরু করতে হবে। ১০ হাজার হল ‘ক্রিটিকাল নম্বর’, এই সংখ্যায় প্লেটলেট নেমে এলে তখন চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ডাক্তারবাবু বলছেন, ডেঙ্গি ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বেশি করে জল বা তরল পানীয় দিতে হবে রোগীকে। প্যাকড সেল ভলিউম (PSV) টেস্ট করা জরুরি। রক্তে লোহিত রক্তকণিকার মাত্রা পরীক্ষা করা হয় এতে। যদি পিএসভি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে তখন স্যালাইন দিতে হবে রোগীকে। হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করা বশি ভাল। দিনে দু’বার করে পিএসভি টেস্ট করে স্যালাইন দিতে হবে। কোষ থেকে যে পরিমাণ জল শুষে নেবে ডেঙ্গি ভাইরাস, সেই ঘাটতি মেটাতে স্যালাইন ট্রিটমেন্টই এক্ষেত্রে আসল। তাছাড়া জ্বর কমাতে প্যারাসিটামল দেওয়া হবে। অন্য জটিলতা না থাকলে এইভাবেই থেরাপি চলবে। খেয়াল রাখতে হবে শরীরে জলের ঘাটতি কতটা হচ্ছে, সেইমত স্যালাইন ট্রিটমেন্ট চলবে। যখন দেখা যাবে রোগ সারতে শুরু করেছে, আবার শরীরে জলের স্বাভাবিক মাত্রা ফিরে আসছে, তখন রোগীকে পরীক্ষা করে স্যালাইন দেওয়া কমিয়ে দিতে হবে বা বন্ধ করতে হবে। 

Signs and Symptoms of Dengue Fever

ডেঙ্গি হেমারেজিক বা শক সিন্ড্রোম হলে উদ্বেগ বাড়ে

ডেঙ্গির উপসর্গ দেখা দিলে ২-৩ দিনের মধ্যে এন এস ওয়ান অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করাতে হবে (dengue) । এ ছাড়া আই জি এম এবং আই জি জি এলাইজা টেস্টও করাতে হতে পারে। কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলে ডেঙ্গির সঙ্গে ম্যালেরিয়া পরীক্ষাও জরুরি। 

ডেঙ্গি শক সিনড্রোম থেকে শরীরে জলশূন্যতা তৈরি হয়। সঙ্গে সঙ্গে পাল্‌স রেট অনেকটা বেড়ে যায় এবং রক্তচাপ খুব কমে যায়। শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। শ্বাসপ্রশ্বাস খুব দ্রুত চলে। রোগী অস্থির হয়ে ওঠেন। তখন সময় নষ্ট না করে হাসপাতালে ভর্তি করানো উচিত। সঠিক সময় স্যালাইন ট্রিটমেন্ট শুরু করতে পারলে সমস্যা অনেক কমে যায়।

আর ডেঙ্গি হেমারেজিক হয়েছে কিনা তা বোঝা যাবে যখন শরীরের নানা জায়গা থেকে রক্ত বেরোতে থাকবে। মল বা প্রস্রাবের সঙ্গে রক্তপাত হবে, নাক-মুখ দিয়েও রক্ত বেরোতে পারে।  ‘হেমারেজিক’-এর অর্থ রক্তপাত। রোগীর শরীরের বিভিন্ন ধমনী ও শিরা ফেটে গিয়ে রক্ত ও প্লাজমা বেরিয়ে যেতে শুরু করে। বাইরে থেকে রক্ত দিলেও অনবরত রক্তক্ষরণ হতে থাকে রোগীর। অবস্থা ক্রমশ জটিল হয়ে ওঠে। ডেঙ্গি হেমারেজিক ফিভার হলে হাসপাতালে ভর্তি ছাড়া গতি নেই।