
ডেঙ্গি হেমারেজিক ও শক সিন্ড্রোমেই মৃত্যু হচ্ছে, জ্বর কমতে শুরু করার পরেই বিপদটা বাড়ে
গুড হেলথ ডেস্ক
ডেঙ্গি হেমারেজিক ফিভার (Dengue Hemorrhagic Fever) বা শক সিন্ড্রোমেই মৃত্যু হয় রোগীর। ডেঙ্গি জ্বর তিন থেকে সাত দিন থাকে, এরপর জ্বর কমতে থাকে। জ্বর কমতে শুরু করার পর পরই আসল বিপদটা শুরু হয়। এইসময়ে শরীরে সাইটোকাইন-স্টর্ম (cytokine storm) শুরু হয়ে যায়, ফলে প্রদাহ বাড়ে। নানা জটিলতার সূত্রপাত তখন থেকেই। ডেঙ্গি জ্বর কেন এত মারাত্মক ও প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে, তার কারণ ব্যাখ্যা করলেন আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক (কমিউনিটি মেডিসিন) ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাঃ অনির্বাণ দলুই।
ডেঙ্গি জ্বর কমার পরেই শুরু হয় সাইটোকাইন স্টর্ম
ডাক্তারবাবু বলছেন, ডেঙ্গি (Dengue) হেমারেজিক ফিভার আগেও হত। বস্তুত, ডেঙ্গিতে মৃত্যুর কারণই হল হয় হেমারেজিক ফিভার, না হলে শক সিন্ড্রোম। ডেঙ্গির চরিত্রই তাই। জ্বর যেদিন থেকে কমতে থাকে, ডেঙ্গির খারাপ সময়টা সেদিন থেকেই শুরু হয়। এরপর থেকেই রোগীর শরীরে সাইটোকাইন স্টর্ম বা হাইপার ইমিউন রিঅ্যাকশন শুরু হয়ে যায়। সাইটোকাইন স্টর্ম হচ্ছে যখন শরীরের ইমিউন কোষই (রোগ প্রতিরোধী কোষ) শত্রু হয়ে ওঠে। অতিসক্রিয় হয়ে অন্যান্য সুস্থ কোষগুলিকে আক্রমণ করতে শুরু করে। তখন শরীরে নানারকম প্রদাহ সৃষ্টিকারী পদার্থগুলো বের হতে থাকে। ফলে শরীরের ভেতরে প্রদাহ বা ইনফ্ল্যামেশন (Inflammation) শুরু হয়।
এই প্রদাহ সৃষ্টিকারী পদার্থগুলো মূলত দুটো জায়গায় হামলা করে–১) প্লেটলেট ( Platelets) বা অনুচক্রিকাগুলোকে ভাঙতে থাকে, ২) ক্যাপিলারি বা শরীরের রক্তজালিকাগুলির দেওয়ালে ফুটো করে দেয়। ফলে সেখান থেকে ফ্লুইড লিক করতে থাকে। ফলে কোষেগুলিতে জলশূন্য়তা তৈরি হয়। ডেঙ্গি শক সিন্ড্রোমের কারণ এটাই। এই সময় ফ্লুইড থেরাপি শুরু করতে হয়। ফ্লুইড থেরাপি বা স্যালাইন ট্রিটমেন্ট সঠিকভাবে হলে রোগীর ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়।
ডেঙ্গি হেমারেজিক ফিভারের (Dengue Hemorrhagic Fever) কারণও এই অতিরিক্ত প্রদাহ বা সাইটোকাইন স্টর্ম। প্লেটলেট ভাঙতে শুরু করে। রোগীর শরীরের বিভিন্ন ধমনী ও শিরা ফেটে গিয়ে রক্ত ও প্লাজমা বেরিয়ে যেতে শুরু করে। বাইরে থেকে রক্ত দিলেও অনবরত রক্তক্ষরণ হতে থাকে রোগীর। নাক-মুখ, দাঁত, মাড়ি, মলদ্বার, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত বেরিয়ে আসে। এইজন্য বলা হয়, ডেঙ্গি রোগীর জ্বর কমার পর থেকেই নিয়মিত প্লেটলেট কাউন্ট টেস্ট ও পিএসভি (প্যাকড সেল ভলিউম) টেস্ট করতে হয়। প্লেটলেট যদি ৩০ হাজার বা তার নীচে নেমে যায় তাহলে বাইরে থেকে প্লেটলেট দেওয়ার দরকার পড়ে।
ডাক্তারবাবু বলছেন, ডেঙ্গি জ্বর কমতে থাকার তিন-চারদিন পর থেকেই প্লেটলেট বাড়তে থাকে। যদি হেমারেজ হয় বা রক্তক্ষরণ শুরু হয় এবং প্লেটলেট সাঙ্ঘাতিকভাবে কমতে থাকে, তাহলে হাসপাতালে ভর্তি হয় প্লেটলেট দিতে হবে রোগীকে। আর যদি, প্লেটলেট তেমনভাবে না কমে তাহলে বাইরে থেকে দেওয়ার দরকার নেই। সেক্ষেত্রে বাড়িতে থেকেই রোগীর চিকিৎসা হতে পারে। আর যদি তেমন কোনও উপসর্গ দেখা দেয় যেমন–অতিরিক্ত দুর্বলতা, রক্তক্ষরণ, নাড়ির গতি কমে যাওয়া, সবসময় বমি পাওয়া, মাথা ঘোরা, শ্বাসকষ্ট বা রোগী যদি অজ্ঞান হয়ে যায়, তাহলে দেরি না করে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
প্লেটলেট ৭০-৮০ হাজার থাকলে বাইরে থেকে দেওয়ার দরকার নেই। ডাক্তারবাবু বলছেন, অনেকেই ভাবেন প্লেটলেট কমে যাওয়া মানেই বিপদ। তা নয়। ডেঙ্গি হলে প্লেটলেট কমেই, আবার তা বেড়েও যায়। যদি রক্তক্ষরণ না হয় এবং প্লেটলেট ৩০ হাজারের নীচে না নেমে যায়, তাহলে দেওয়ার দরকার নেই। অতিরিক্ত প্লেটলেট ক্ষতি করতে পারে।
এক্সট্রিম এজ গ্রুপ অর্থাৎ ছোট বাচ্চা বা বয়স্কদের জ্বর হলে সাবধান হতে হবে। কেন না এদের ক্ষেত্রেই সমস্যা জটিল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তার মানে এই নয় যে জ্বর হলেই আতঙ্কিত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে দিতে হবে। অবশ্যই ডাক্তার দেখিয়ে তাঁর পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা করা উচিত। এই সময়টায় যেকোনও বয়সেই জ্বর হলে ডাক্তার দেখানো দরকার। ডেঙ্গিতে ডিহাইড্রেশনের সম্ভাবনা অনেক বেশি। তাই পথ্যের ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে। এই সময়ে খাবার ইচ্ছে থাকে না বলে বারে বারে অল্প অল্প করে জল, শরবত, ডাবের জল, স্যুপ, টাটকা ফল বা ফলের রস দিলে ভাল হয়। সেই সঙ্গে বাড়ি আর তার আশপাশে পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর দিতে হবে।