করোনার চেয়েও ছোঁয়াচে এই মরশুমি জ্বর! ঘরে ঘরে সর্দি-কাশিতে নাজেহাল আট থেকে আশি, কারণ কী

চৈতালী চক্রবর্তী

করোনাভাইরাস চিনে যতই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠুক, এ বাংলায় আর তেমনভাবে মাথা তুলতে পারবে না। অন্তত এই মুহূর্তে করোনা মারাত্মক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা নেই। এমনটাই জানিয়েছেন, বারাসাত মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক (কমিউনিটি মেডিসিন) ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাঃ অনির্বাণ দলুই

চিনে করোনা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। এ দেশে কোভিডের ঢেউ আসবে না বলে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক সতর্ক করলেও আতঙ্ক থেকেই গেছে। বিশেষ করে, এই সময়টাতে ঘরে ঘরে সর্দি, কাশি, গলা খুসখুস, জ্বর হচ্ছে। এইসব উপসর্গ করোনার কি না (Viral Infections) সে নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে। এই প্রসঙ্গে ডাক্তার অনির্বাণ দলুই বলেছেন, করোনা ফেরার সম্ভাবনা তেমন নেই। তবে করোনা যে খেল দেখিয়ে গেছে তার সুদূরপ্রসারী একটা প্রভাব আছে। অন্যান্য ভাইরাসও এখন জাঁদরেল হয়ে উঠেছে। সর্দি-কাশির নিরীহ অ্যাডেনোভাইরাস এখন করোনার থেকেও বেশি ছোঁয়াচে। আরও কিছু ভাইরাস আছে যারা মাথাচাড়া দিয়েছে। এখন যে জ্বর, সর্দি-কাশি, গলা ব্যথা ইত্যাদি হচ্ছে তার কারণ হল–অ্যাডেনোভাইরাস, রাইনোভাইরাস ও ইনফ্লুয়ে়ঞ্জা ভাইরাস (Viral Infections)। ডাক্তারবাবু বলছেন, এইসব ভাইরাস কোভিডের (সার্স-কভ-২) চেয়েও বেশি তাড়াতাড়ি ছড়াতে পারে। অনেক বেশি ছোঁয়াচে।

Viral Fever

খামখেয়ালি আবহাওয়ার কারণেই পরিপুষ্ট হচ্ছে ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ারা

ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার এত বাড়বাড়ন্তের কারণ হল খামখেয়ালি আবহাওয়া (weather change sickness)। কখনও ঠান্ডা, আবার কখনও গরম, এত দ্রুত আবহাওয়া বদলাচ্ছে যে রোগজীবাণুরাও আরও বেশি সক্রিয় হয়ে উঠছে। একটা সময় ঋতু বদলের সময়েই বেশি সর্দি-জ্বর হত। এখন আবহাওয়ার কোনও ঠিকঠিকানাই নেই। আজ গরম, তো কাল ঠান্ডা, পরশু বৃষ্টি। এই বদলটা (Change of Weather) এত ঘন ঘন হচ্ছে, জীবাণুরাও পরিবর্তিত আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছে। দ্রুত বংশবিস্তার করছে। আরও বেশি সংক্রামক ও ছোঁয়াচে হয়ে উঠছে।

এই পরিবর্তিত আবহাওয়ার কারণেই নানা রোগ বাড়ছে।  শীতের সময় এমনিতেই  সর্দিকাশিতে সবচেয়ে বেশি মানুষ ভোগেন। একে আমরা ‘কমন কোল্ড’ বলে থাকি। রাইনোভাইরাস নামের এক ধরনের ভাইরাস এর জন্য দায়ী। এই ভাইরাস মূলত নাক, মুখ, চোখ দিয়ে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। শীতের সময়ে এই ভাইরাস মূলত নাসারন্ধ্রে বাসা বেঁধে সংখ্যা বৃদ্ধি করে। ফলে নাক দিয়ে জল পড়ে। নাক বন্ধ হয়ে যায়। কাশি, হাঁচি, মাথাব্যথা ও জ্বর জ্বর ভাব দেখা দেয়। বাচ্চা ও বয়স্করা বেশি আক্রান্ত হয় এই রোগে।

 

শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতি বেশি হচ্ছে, করোনার চেয়েও বেশি ছোঁয়াচে হয়ে উঠেছে তিন ভাইরাস

ডাক্তারবাবু বলছেন, সর্দি-কাশির অ্যাডেনোভাইরাস, রাইনোভাইরাস করোনার চেয়েও বেশি ছোঁয়াচে হয়ে উঠেছে। সেই সঙ্গে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস তো রয়েছেই। রেসপিরেটারি সিনসিটিয়াল ভাইরাসও (RSV) জ্বর, গলা ব্যথার কারণ। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের অনেকগুলো ধরন আছে—টাইপ এ, টাইপ বি, এইচ১এন১ (নন-সোয়াইন ফ্লু)। শহরে এখন এই এইচ১এন১ ভাইরাসের সংক্রমণ বেশি হচ্ছে। গা গরম, ধুম জ্বর, হাত-পায়ে ব্যথা, দুর্বলতা, অনেক সময় শ্বাসকষ্টও ভোগাচ্ছে। ভাইরাল ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের দিকেই বেশি নজর দেওয়া হচ্ছে। টানা জ্বর, বা হাল্কা শ্বাসের সমস্যা হলে হেলাফেলা না করে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়াই ভাল।

 common cold in children

বাচ্চাদের উপসর্গ দেখে বোঝা যাচ্ছে, রেসপিরেটারি ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। প্রতি বছরই ঋতু বদলের এই সময়টাতে রেসপিরেটারি ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়ায়। বাচ্চারাই বেশি আক্রান্ত হয়। ইদানীংকালে ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া ও করোনা ভাইরাসের মধ্যে এই ভাইরাসও (respiratory syncytial virus) দ্রুত তার ডালপালা মেলছে। সদ্যোজাত থেকে পাঁচ বছর বয়স অবধি শিশুরা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। 

ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস বা রাইনোভাইরাসের সংক্রমণ হলে কোভিডের মতোই উপসর্গ দেখা দেয়। তাই অনেকেই কোভিডের সঙ্গে ভাইরাল জ্বরকে গুলিয়ে ফেলছেন। ডাক্তারবাবু বলছেন, আসলে করোনা নয়। এই মুহূর্তে করোনা আর তেমনভাবে ছড়াবেও না। তবে এইসব ভাইরাস থেকে সতর্ক থাকতে হবে। এইসব ভাইরাসের সংক্রমণ হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কমে যায়। ফলে পরিবারে একজনের হল তা থেকে বাকিদেরও রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে। বিশেষ করে বাচ্চা ও বয়স্কদের। তাই অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে।

common cold virus

কী কী লক্ষণ দেখলে সতর্ক হতে হবে

জ্বর ও শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা তিন দিনের বেশি থাকলেই হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।

সর্দি-কাশি, ক্রমাগত নাক দিয়ে জল পড়া, গলা শুকিয়ে যাওয়া, গলায় ব্যথা হলে দেরি করা ঠিক হবে না।

দ্রুত শ্বাস নেওয়া, শ্বাসপ্রশ্বাসের সময় বুক ধড়ফড় করা, এই ভাইরাস সংক্রমণের (respiratory syncytial virus) লক্ষণ।

কীভাবে সতর্ক থাকবেন
বেশির ভাগ জ্বরের নেপথ্যেই শ্বাসনালী, গলা, পেট-সহ কোনও না কোনও সংক্রমণ আছে। ডাঃ অনির্বাণ দলুই বলছেন, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসও ড্রপলেট বা নাক-মুখ থেকে বেরনো জলকণার মাধ্যমে ছড়াতে পারে। তাই মাস্ক পরা খুবই জরুরি। কোভিডের কারণে আমাদের মাস্ক পরাতে অভ্যাস হয়ে গেছে, এই অভ্যাস বজায় রাখাই ভাল। তাছাড়া হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবহার, ভিড় এড়িয়ে চলা এগুলো মানতেই হবে।
Adult Respiratory Syncytial Virus (RSV)

করোনা কমে যাওয়ায় মাস্ক পরাও উঠে গেছে। সরকার থেকেও ছাড় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মাস্ক শুধু করোনা ঠেকায় না, সর্দি-কাশির ভাইরাসও আটকায়। এখনকার সময় যেভাবে শ্বাসের রোগ ও ভাইরাল জ্বর ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে তাতে মাস্ক পরা সবথেকে আগে দরকার।

বারে বারে হাত ধুতে হবে। বিশেষ করে বাইরে থেকে এলে হাত ভাল করে ধুয়ে, স্যানিটাইজ করে তবেই ঘরে ঢুকুন।

করোনা কমে গেলেও শেষ হয়ে যায়নি। আরও অনেকরকম  ভাইরাসও বেড়েছে। তাই পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখা উচিত। এই সময়টাতে বেশি ভিড় বা জমায়েতে যাবেন না। বিয়েবাড়ি, সামাজিক অনুষ্ঠানে গেলে চেষ্টা করুন মাস্ক পরার ও স্যানিটাইজার সঙ্গে রাখার। সম্ভব হলে ভিড় এড়িয়ে চলবেন। বাচ্চাদেরও সামলে রাখবেন।