
ছানি পড়লেই কি অপারেশন করতে হবে? ক্যাটারাক্ট নিয়ে অনেক ভুল ধারণা ভাঙলেন ডাক্তারবাবু
গুড হেলথ ডেস্ক
চল্লিশ পার হলেই চালসে। এমন একটা চালু প্রবাদ রয়েছে বাংলায়। বয়স বাড়লে চোখে ছানি পড়াটা অস্বাভাবিক নয়। তবে এখন ছানি (Cataract) কমবয়সিদেরও পড়ছে। একটা সময়ে চোখের অপারেশন মানেই চিন্তা বাড়ত। কিন্তু এখন ক্যাটারাক্ট বা ছানি অপারেশন (Cataract Surgery) অনেক সহজ হয়ে গেছে। এখন আর চোখে কালো কাপড় বা চশমা পরে ঘুরে বেড়াতে হয় না ছানি অপারেশনের পরে। ছুরি, কাঁচির ভয়ও কমেছে কিছুটা। তবুও অনেকে ভয়ে ছানির চিকিৎসা করাতে চান না ছানি অপসারণের প্রক্রিয়া এখন অনেক বেশি ব্যথাহীন ও নির্ঝঞ্ঝাট। বিশেষত ফেকো-র মতো আধুনিক পদ্ধতিতে ছানি অপারেশনে সাফল্য বেড়েছে বেশ কয়েক গুণ। অপারেশনের পরদিনই ছেড়ে দেওয়া হয় রোগীকে।
ছানি কেন পড়ে? কী কী কারণে কমবয়সিদেরও ছানি পড়ছে? এর চিকিৎসা কী এই সব বিষয়ে সহজ করে বললেন সুশ্রুত আই ফাইন্ডেশন অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের কনসালট্যান্ট ডা. অরিন্দম দেব।
আর্লি ক্যাটারাক্ট খুব বেড়েছে,কারণ কী?
ছানি পড়ার সত্যিই কোনও বয়স নিয়ে। বার্ধক্যজনিত কারণে ছানি পড়ে ঠিকই, তবে অকালে ছানি পড়ার অনেক কারণ আছে। প্রথমত জন্মগত ক্যাটারাক্ট যাকে বলে কনজেনিটাল ক্যাটারাক্ট। বাচ্চা ক্যাটারাক্ট নিয়ে জন্মাচ্ছে বা জন্মের কয়েক মাসের মধ্যে এক চোখে বা দু’চোখে (কনজেনিটাল টোট্যাল ক্যাটারাক্ট) ছানি পড়ছে এমনও দেখা যায়। কনজেনিটাল ক্যাটারাক্টের ক্ষেত্রে মায়ের গর্ভে থাকার সময়েই লেন্সের ওপর প্রোটিন জমে ক্লাউডিং হতে পারে। গর্ভাবস্থায় মা যদি কোনও রোগে আক্রান্ত হয়, ভাইরাস জনিত সংক্রমণ থাকে তাহলে শিশুর চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হতে পারে। তাছাড়া মা নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ খেলে, বংশগত রোগ বা মেডিবলিক ডিজিজ ডায়াবেটিস, গ্যালাকটোসেমিয়া বা জিনগত রোগ থাকলে শিশুর কনজেনিটাল ক্যাটারাক্ট হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
দ্বিতীয়ত, তাছাড়া চোখে আঘাত লাগলে তার থেকেও ছানি পড়তে পারে। অর্থাৎ ট্রমাটিক ক্যাটারাক্ট, চোখে চোট লেগেছে বা পড়ে গেছে, তার থেকেও ছানি পড়তে পারে। খেলাধূলার সময় বাচ্চাদের এমন হতে পারে। তাছাড়া ছোট থেকেই অপরিচ্ছন্ন জায়গায় কাজ করছে, কলকারখানায় কাজ করছে এমন কমবয়সিদেরও অকালে ছানি পড়তে পারে।
তৃতীয়ত, ডায়াবেটিসের কারণে ক্যাটারাক্ট হতে পারে, যাকে বলে ডায়াবেটিক ক্যাটারাক্ট। আবার ডায়াবেটিসের কারণে কমবয়সিদের প্রিসেলাইন ক্যাটারাক্ট হতে পারে। এখন সেডেন্টারি লাইফস্টাইলের কারণে কম বয়স থেকেই ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে, এমনকী বাচ্চাদেরও ডায়াবেটিস হচ্ছে। তার থেকেও অকালে ছানি পড়ার ঝুঁকি বাড়ছে।
চোখের কিছু কিছু রোগ হয়, যেমন চোখেও বাত হয়। চোখের ইউভিয়াল টিস্যুর প্রদাহ হল ইউভিআইটিস (Uveitis)। সাধারণত যাঁদের বাতের সমস্যা রয়েছে তাঁদের বাত থেকে চোখে এই প্রদাহ হয়। ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সিদের এই সমস্যা হতে পারে, তার থেকেও চোখে ছানি পড়তে পারে।
পরিবেশ দূষণ থেকে কি ক্যাটারাক্ট হতে পারে?
সূর্যের আলো বা আলট্রাভায়োলেট রশ্মি ক্যাটারাক্টের কারণ হতে পারে। এখন পরিবেশে দূষণ বেশি, ওজোন স্তর পাতলা হচ্ছে। ফলে সরাসরি আলট্রাভায়োলেট রে বা অতিবেগুনী রশ্মি চোখে পড়ছে। চড়া রোদে বেরোলে এমনতিও চোখে জ্বালা করে, চোখ চুলকায়। পরিবেশ দূষণজনিত কারণ ছানি পড়ার জন্য কতটা দায়ী সেটা এখনও গবেষণা সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে অত্যধিক দূষণ, সবর্যের অতিবেগুনী রশ্মি ছানি পড়ার কারণ হতে পারে।
মোবাইল ল্যাপটপ ইত্যাদি বেশি ব্যবহার করলে কি আর্লি ক্যাটারাক্ট হয়?
মোবাইল বা কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে একটানা তাকিয়ে থাকলে বা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করলে ড্রাই আইয়ের সমস্যা হতে পারে। চোখে পলক পড়া কমে যায়। ফলে চোখ দিয়ে অনবরত জল পড়া, চোখ লাল হয়ে যাওয়া, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়া, চোখ চুলকানোর মতো সমস্যাই বুঝিয়ে দেবে যে, আপনার চোখের জল শুকিয়ে যাচ্ছে। স্ক্রিনের দিকে একটানা তাকিয়ে থাকলে তার থেকে সরাসরি ছানি পড়ার সমস্যা হতে পারে এমনটা নয়। তবে পরোক্ষ প্রভাব আছে বইকি।
দেখা গেছে, যাঁরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইল, ল্যাপটপে বুঁদ, তাঁদের হাঁটাচলা, শারীরিক পরিশ্রম কম। তাঁদের খাওয়াদাওয়ার ধরনও আলাদা। এরা কম পরিশ্রমী ও জাঙ্ক ফুট খেতে অভ্যস্ত যা কম বয়সেই ডায়াবেটিসের কারণ হয়ে ওঠে। সেডেন্টারি লাইফস্টাইলে ওবেসিটি, অতিরিক্ত কোলেস্টেরল ও ডায়াবেটিসের সমস্যা দেখা দেয়। আর ডায়াবেটিস থেকে আর্লি ক্যাটারাক্ট হতে পারে।
ফেকো কী ধরনের সার্জারি? লেজারে হয়?
একজন স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন মানুষের চোখের ভেতর একটা স্বচ্ছ লেন্স থাকে। এই লেন্সই আমাদের দেখতে সাহায্য করে। বয়স বাড়লে ধীরে ধীরে এই লেন্স অস্বচ্ছ হয়ে যেতে থাকে। ফলে বাইরে থেকে আলো আর ভেতরে প্রবেশ করতে না। ফলে স্পষ্টভাবে দেখতে অসুবিধা হয়। কর্নিয়া ও আইরিসের পিছনে থাকা স্বচ্ছ লেন্স বিভিন্ন কারণে অস্বচ্ছ হয়ে পড়ে। তখন সেই অস্বচ্ছ লেন্স বের করে অ্য লেন্স বসিয়ে দেওয়া হয় চোখের ভেতরে। এটাই হল ছানি অপারেশন।
আগে যে মাইক্রোসার্জারি হত বা যাকে বলে ‘স্মল ইনশিসন সার্জারি’, তাতে চোখে ৫-৬ মিলিমিটার কেটে লেন্স বের করে আনা হত। তারপর সেই ফাঁকা জায়গায় কৃত্রিম লেন্স বসানো হত। তারও আগে আরও বড় কাটাকুটি করে লেন্স বের করা হত। এরপর কৃত্রিম লেন্স বসিয়ে সেলাই করা হত। এখন ফেকো সার্জারি করা হয়। এতে লেন্সটা গোটা বের করা হয় না, চোখের ভেতরেই লেন্সটা গলিয়ে দেওয়া হয়। ধরুন, লেন্স গলিয়ে যে লিকুইড তৈরি হল সেটা অ্যাসপিরেট মানে শোষণ করে নেওয়া হয়। ছোট পেনের মতো জিনিস চোখে ঢুকিয়ে ২ মিলিমিটার সাইজের ছিদ্র করা হয়। ওই ছিদ্র দিয়েই ডিভাইসটা ঢুকিয়ে শোষণ করে নেওয়া হয়। তারপর যে ফাঁকা জায়গা তৈরি হল সেখানে ফোল্ডেবল লেন্স বসানো হয়।
ফোল্ডেবল লেন্স বসানোর প্রক্রিয়া আছে। চোখে যে ২ মিলিমিটার ছিদ্র করা হল তার মধ্যে দিয়েই সেই লেন্স ঢুকে যাবে। সাধারণত চোখের লেন্সের মাপ ৬ মিলিমিটার হয়। কৃত্রিম লেন্সকে ফোল্ড করে ২ মিলিমিটার আকারের করা হয়। সেটা ওই ছিদ্র দিয়ে ঢুকে ফাঁকা জায়গায় গিয়ে আবার খুলে পূর্ণাঙ্গ আকার নিয়ে নেবে। মানে ৬ মিলিমিটার আকারের হয়ে যাবে। এই পদ্ধতির সুবিধা হল, যেহেতু মাত্র ২ মিলিমিটার ছিদ্র করা হয় তাই রক্তপাতের সম্ভাবনা থাকে না। খুব তাড়াতাড়ি ক্ষত শুকিয়ে যায়, দৃষ্টিও ঝাপসা হয় না। রোগীর একেবারেই যন্ত্রণা হয় না। একদিনের মধ্যেই দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে যায়।
আর লেজার সার্জারি একটু অন্যভাবে হয়। লেজার দিয়ে হাতে সার্জারি করার দরকার পড়ে না। দুই থেকে তিনটে স্টেপ লেজারেই হয়ে যায়। তবে পূর্ণাঙ্গ ক্যাটারাক্ট সার্জারি লেজারে সম্ভব নয়। কিছুটা পদ্ধতি লেজারে করা সম্ভব, বাকিটা আবার সেই ফেকোতেই ফিরতে হয়।
ছানি প্রতিরোধ করার কোনও উপায় আছে?
ছানি টকে দেওয়া বা প্রতিরোধ করা মুশকিল। তবে নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করানো উচিত, বিশেষ করে যাঁদের ডায়াবেটিসের সমস্যা আছে তাঁদের কোনও রুটিন আই চেক আপ করান দরকার, এ ছাড়া ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, রোদ্দুরে বেরোলে ইউভি প্রতিরোধী রোদ চশমার সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। অন্যান্য অসুখ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যদি কেউ এমন পেশার সঙ্গে জড়িত থাকেন যেখানে চোখে প্রদাহ হতে পারে বা চোখে আঘাত লাগার ঝুঁকি থাকতে পারে, তাহলে সেদিক দিয়ে সাবধান হতে হবে। যদি কেউ ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করেন যেখানে চোখে লোহার গুঁড়ো ছিটকে আসছে, সেখানে প্রোটেকটিভ গ্লাস পরতেই হবে।
লাইফস্টাইল মডিফিকেশন জরুরি। খাওয়াদাওয়ায় নজর দিতে হবে।
বার্ধক্যজনিত ক্যাটারাক্ট আটকানো যায় না। ষাটের পর থেকেই লেন্স অস্বচ্ছ হতে শুরু করে। তাি সেই সময় থেকে চোখের রুটিন চেকআপ জরুরি।
ছানি অপারেশন নিয়ে অনেক ভ্রান্ত ধারণা আছে
আগে মনে করা হত গরমকালে ছানি অপারেশন করা ঠিক নয়। কিন্তু সেটা এখন প্রযোজ্য নয়। আগে ছানি অপারেশনে চোখে অনেকগুলো সেলাই পড়ত, তাি সমস্যা হত। কিন্তু এখন ফেকো অনেক আধুনিক। তাই সেই ভয়টা নেই। গরম হোক বা শীত হোক, আবহাওয়া কোনও প্রভাবই ফেলবে না।
ক্যাটারাক্ট হলেই অপারেশন করতে হবে এমনটা নয়। এটা পরীক্ষা করে ডাক্তার সিদ্ধান্ত নেবেন। ক্যাটারাক্ট কতটা হয়েছে, কতটা গভীরে হয়েছে, তার অবস্থান কেমন–এইসব দেখে সার্জারি করা হয়। ছানি ধরা পড়লে যখন দৈনন্দিন কাজকর্মে অসুবিধে হবে তখনই অস্ত্রোপচার করা উচিত। পাকার জন্য অপেক্ষা করার কোনও দরকার নেই, বরং দেরি হলে নানান জটিলতা দেখা দিতে পারে। ধরুন, কেউ ড্রাইভার, তাঁকে দূরে দেখতে হয়। ছানির কারণে দেখার সমস্যা তৈরি হচ্ছে তখন দ্রুত সার্জারি করতে হবে। আবার ধরুন শিক্ষক, যাঁকে কাছের জিনিস দেখতে হবে, ব্ল্যাকবোর্ডে লিখতে হবে, তাঁর যদি ক্যাটারাক্ট হয় এবং কাছের জিনিস দেখতে সমস্যা হয় তাহলেও তাড়াতাড়ি অপারেশন করতে হবে। ঠিক কোন পর্যায়ে গিয়ে অপারেশন করতে হবে সেটা পরিস্থিতি বিচার করে ঠিক করতে হয়।