
ঘুমের মধ্যে বোবায় ধরছে! হাত-পা আড়ষ্ট, দম আটকে আসে, ভূত-প্রেত নয় আসলে কী এই অবস্থা?
গুড হেলথ ডেস্ক
ছোটবেলায় ঠাকুমা-দিদিমাদের মুখে শুনে থাকবেন বোবায় ধরার কথা। এখনও মা-কাকিমাদের মুখে এই বোবায় ধরার কথা শোনা যায়। ঘুমের মধ্যে কারও বিকট গোঙানির আওয়াজ পেলে তখন বলা হয় ‘বোবায় ধরেছে’ (Sleep Paralysis) বা ‘নিশিতে পেয়েছে’। গ্রামেগঞ্জে এই কথাটা খুব প্রচলিত। এখনকার আধুনিক সমাজেও এই বোবায় ধরা ব্যাপারটা নিয়ে আতঙ্ক রয়েছেই। অনেকেই এর সঙ্গে ভূত-প্রেত, দানব ইত্যাদির গল্প জুড়ে দেন।
কুসংস্কার, ভূতের গল্প যতই জুড়ে থাক না কেন, এই বোবায় ধরা ব্যাপারটা কিন্তু বেশ কষ্টকর। ঘুমের মধ্যে আচমকাই মনে হবে হাত-পা বেঁধে ফেলেছে কেউ। আড়ষ্ট হয়ে যাবে সারা শরীর। হাত-পা নাড়ানোর ক্ষমতাটুকুও চলে যাবে। ঘন ঘন শ্বাস পড়বে, কথা বলার শক্তিও থাকবে না। হ্যালুসিনেশন করতে থাকবেন আপনি, মনে হবে কেউ যেন গলা টিপে ধরছে, বা অশরীরীরা ঘিরে ধরেছে আপনাকে। চোখের সামনে আবছায়া সব প্রতিমূর্তি দেখা যাবে। অনেকে আবার এমনও বলেছেন, ঘুমের মধ্যেই দেখেছেন ভয়ঙ্কর কোনও দানব বুকের ওপর চেপে বসেছে, বড় বড় নখওয়ালা হাত দিয়ে গলা টিপে ধরছে, চিৎকার করার চেষ্টা করেও পারছেন না, মুখ থেকে শুধু অস্ফুটে কিছু গোঙানির শব্দ বেরিয়ে আসছে। হাত-পা যেন সেঁটে গেছে বিছানার সঙ্গে, নড়াচড়ার শক্তিও নেই। কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট স্থায়ী হয়েছে এই অবস্থা (Sleep Paralysis)।
বিজ্ঞানের ভাষায় এই অবস্থার নাম স্লিপ প্যারালাইসিস (Sleep Paralysis)। এর সঙ্গে ভুত-প্রেত বা কোনওরকম কুসংস্কার জড়িত নয়। ঘুমের মধ্যেই মস্তিষ্ক ও মনের এমন এক স্থিতি যেখানে এইসব আজগুবি জিনিস চোখের সামনে ঘুরছে বলে মনে হয়, হাত-পায়ের পেশি শিথিল হয়ে যায়। সোজা কথায়, স্লিপ প্যারালাইসিস হল ঘুমের মধ্যে সাময়িক পক্ষাঘাত। এক মিনিটেরও বেশি স্থায়ী হতে পারে এই অবস্থা।
স্লিপ প্যারালাইসিস (Sleep Paralysis) কেন হয়?
পুরোটাই স্নায়বিক স্থিতি। ঘুম ও জেগে থাকার মাঝামাঝি একটা পর্যায়ে যখন মস্তিষ্ক খুব সজাগ থাকে সে সময়েই এমন পক্ষাঘাত হতে পারে। ঘুম যখন গভীরে পৌঁছয়নি, মস্তিষ্ক সক্রিয় রয়েছে তখনই মানুষ স্বপ্ন দেখে। তেমনই একটি পর্যায়ে যদি পেশিশক্তি কমতে থাকে, মস্তিষ্ক থেকে সঙ্কেত পেশিতে ঠিকমতো না পৌঁছয় তখন পেশির অসাড়তা দেখা যায়। সেইসঙ্গে হিপনাজোইক হ্যালুসিনেশন হতে পারে যাতে– ঘুমের মধ্যে নানারকম অদ্ভুত দর্শন প্রাণী দেখেন অনেকে। আধো ঘুম-আধো জাগরণে এই অবস্থা হয় অনেক সময়।
কাদের স্লিপ প্যারালাইসিস বেশি হয়?
স্লিপ প্যারালাইসিস হওয়ার নির্দিষ্ট কোন বয়স নেই। এই পরিস্থিতি যে কোনও বয়সেই হতে পারে। মূলত তরুণ-তরুণী ও কমবয়সিদেরই বেশি হয়।
প্রচণ্ড মানসিক চাপ ও উদ্বেগে থাকলে এমন অবস্থা তৈরি হতে পারে।
ঘুমনোর আগে অতিরিক্ত নেশা করলেও স্লিপ প্যারালাইসিস হতে পারে।
সোশ্যাল অ্যাঙ্কজাইটি বা প্যানিক ডিসঅর্ডার বা বাইপোলার ডিজঅর্ডারের মতো মানসিক সমস্যা থাকলেও এটি হতে পারে (Sleep Paralysis)।
ব্যক্তিগত সম্পর্ক, পারিবারিক পরিবেশও অনেক সময়ে স্ট্রেসের কারণ হয়, তার থেকেও এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
অল্পবয়সিরা আজকাল স্মার্টফোন, কম্পিউটারে ডুবে থাকে। রাতে বিছানাতেও দীর্ঘ সময় ফোন ঘাঁটাঘাঁটি করে। এই সমস্ত কিছুই ঘুমের নিয়মিত ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে নষ্ট করে, যার পরিণতিতে স্লিপ প্যারালিসিস হতে পারে।
কীভাবে কাটিয়ে উঠবেন এই সমস্যা?
রাতে নির্দিষ্ট সময়েই ঘুমনোর চেষ্টা করুন। ৬-৮ ঘণ্টা টানা ঘুম দরকার।
অসময়ে ঘুম, দিবানিদ্রা, ঘুমনোর সময়ে মোবাইল-ল্যাপটপ ঘাঁটাঘাঁটি বন্ধ করতে হবে।
ঘুমোতে যাওয়ার আগে ভারী খাবার সেইসঙ্গে ধূমপান, অ্যালকোহল এবং ক্যাফিনযুক্ত পানীয় যেমন চা-কফি খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
প্রতিদিন রাতে একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং সকালে একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে জেগে ওঠার অভ্যাস করুন। এমনকি ছুটির দিনগুলোতেও।
শোওয়ার ঘরে আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বিছানা, বালিশ যেন পরিচ্ছন্ন থাকে, ঘর অন্ধকার রাখলে ভাল বা হাল্কা আলো জ্বালাবেন। কোনওরকম কোলাহল বা শব্দ যেন না থাকে।
ঘুম আর স্ট্রেস সামলানো দরকার স্লিপ প্যারালিসিসের (Sleep Paralysis) ক্ষেত্রে। স্ট্রেস নানা কারণে হতে পারে। অসুখ লুকিয়ে থাকতে পারে মনেও, তার চিকিৎসা করা
★ স্লিপ প্যারালাইসিস এক ধরনের শারীরিক অবস্থা, মস্তিষ্ক ও মনের জটিলতার কারণেই হয়। এর সঙ্গে ভূত-প্রেতের কোনও সম্পর্ক নেই। এমন অবস্থা হলে ঝাড়ফুঁক করা বা ওঝা-তান্ত্রিকের কাছে গিয়ে সময় নষ্ট করবেন না, এতে বিপদ বাড়বে।
স্লিপ প্যারালাইসিস নিজে থেকেই ঠিক হয়ে যায়। তবে যদি ঘন ঘন এই সমস্যা হতে থাকে এবং হৃৎস্পন্দন ও শ্বাস প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যায়, রক্তচাপও বাড়তে শুরু করে তাহলে একবার ডাক্তার দেখিয়ে নিতে হবে।