
কখনও তুমুল বৃষ্টি, আবার কখনও প্যাচপ্যাচে গরম। স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া। প্রতিদিনই ভোল বদলাচ্ছে আবহাওয়া (Fever)। আর খামখেয়ালি আবহাওয়ার সঙ্গে বেড়ে চলেছে নানা ধরনের ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া-প্রোটোজোয়ার প্রকোপ। এখন তো ঘরে ঘরে জ্বর। হয় ভাইরাল ফিভার, না হলে কোভিড, এর সঙ্গেই মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়া-চিকুনগুনিয়ার উপদ্রবও বেড়েছে। আবার ইনফ্লুয়েঞ্জা, টাইফয়েডেও ভুগছেন অনেকে। বাচ্চারাও আক্রান্ত।
জ্বরের (Fever) প্রকারভেদে এর গুরুত্ব ও চিকিৎসাও বদলে যায়। অনেক সময় জ্বর হলেও কী ধরনের জ্বর তা বুঝতেই কেটে যায় অনেকগুলো দিন। প্রয়োজনীয় রক্ত পরীক্ষা করাতেও তাই দেরি হয়ে যায়। কী ধরনের জ্বর তা না বুঝেই সাধারণ জ্বরব্যধির ওষুধ খেয়েই সপ্তাহ খানেক সময় নষ্ট করে ফেলেন রোগী। সে কারণেই বিভিন্ন ধরনের জ্বরের উপসর্গের ফারাকটুকু জেনে রাখা খুবই জরুরি।
বর্ষার এই সময়টাতে যেসব ধরনের অসুখ ঘরে ঘরে হয় তার উপসর্গ চিনে রাখুন। জ্বরের ধরন দেখে সেই মতো চিকিৎসা দরকার। ডেঙ্গি বা ডেঙ্গি হেমারেজিক ফিভার হলে তার পরিণতি মারাত্মক হতে পারে। তাই দেরি করা চলবে না কোনওভাবেই।
চিনে নিন কোন জ্বরের কী ধরন, উপসর্গ কী কী?
ভাইরাল ফিভার
ঘুষঘুষে জ্বর থাকে তিন-চার দিন (Fever)। সর্দি-কাশি হতে পারে, অ্যালার্জির ধাত থাকলে নাক দিয়ে জল পড়বে। মাথা যন্ত্রণা, গায়ে, হাত-পায়ে ব্যথা থাকবে। দুর্বল লাগা, স্বাদে অরুচি এগুলোও ভাইরাল জ্বরের লক্ষণ। কখনও কখনও সারা শরীরের মাংসপেশিতে ব্যথা হয়। ঠিক সময়ে চিকিৎসা করালে অসুখ ও দুর্বলতা সারতে এক সপ্তাহ লেগে যায়। মাথায় জলপট্টি দিলে বা প্যারাসিটামল খেলে জ্বর অনেক সময় নেমে যায়। কিন্তু তিনদিনের বেশি জ্বর থাকলে ডাক্তার দেখিয়ে নিতে হবে।
ডেঙ্গি
ডেঙ্গির প্রাথমিক লক্ষণ হল প্রচণ্ড জ্বর, মাথাব্যাথা, খাদ্যনালীতে সংক্রমণ। সাধারণ ভাইরাল ফিভারের মতোই ডেঙ্গি জ্বরে গা হাত পা ব্যথা করে, মাথার যন্ত্রণা হয়। ডেঙ্গি জ্বরের আর এক উপসর্গ পেটে ব্যথা আর বমি বমি ভাব বা বমি। সঙ্গে ডায়রিয়া আর ধুম জ্বর হলে দেরি না করে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
এই জ্বরে সাধারণত সর্দি-কাশির প্রাদুর্ভাব দেখা না গেলেও ত্বকে নানা রকম র্যাশ ও চুলকানি দেখা যায়। আক্রান্ত হওয়ার ২-৫ দিনের মধ্যে ত্বকে লাল লাল র্যাশ বেরবে। কারও কারও ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। নাক ও দাঁতের গোড়া থেকে রক্তপাতও হতে পারে। ব্লাড প্রেসার কমে যেতে পারে। এই উপসর্গগুলো দেখা গেলে রক্তে প্লেটলেট কমছে কিনা পরীক্ষা করাতে হবে।
এলাইজা টেস্টে ডেঙ্গি ধরা পড়ে। সঠিক সময় চিকিৎসা শুরু হলে অসুখ দ্রুত সেরে যায়।
ডেঙ্গি হেমারেজিক ফিভার
ডেঙ্গি যদি মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে যায় তখন শরীর থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হয় (Fever)। একে ডেঙ্গি হেমারেজিক ফিভার বলে। সাধারণত ডেঙ্গি হলে চোখে খুব ব্যথা করতে পারে। আর অনেকের ডেঙ্গি জ্বরে গা হাত পায়ে ভয়ানক বেশি ব্যথা করে। ডেঙ্গির সংক্রমণ হলে রক্তে অনুচক্রিকা বা প্লেটলেট কাউন্ট কমে যেতে শুরু করে। আর এই কারণে শরীরের বিভিন্ন অংশে হেমারেজ অর্থাৎ রক্তক্ষরণ হয়। ডেঙ্গি হেমারেজিক ফিভারে নাক ও মুখ থেকে রক্ত বেরতে পারে। প্লেটলেট দ্রুত কমতে থাকবে, রোগীর শ্বাসকষ্ট হবে। ব্লাড প্রেসার কমে যাবে।
ম্য়ালেরিয়া
ম্যালেরিয়া মানেই প্রচণ্ড কাঁপুনি দিয়ে জ্বর (Fever), বমি ভাব চলতেই থাকে। সাধারণত ১০৫-১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা হলে রোগী আরও বেশি দুর্বল হয়ে পড়ে। বাড়াবাড়ি হলে খিঁচুনিও হতে পারে। ঠিক সময়ের রক্তপরীক্ষা এই রোগ নির্ণয় করা জরুরি।
ম্যালেরিয়া অনেক সময়েই বোঝা যায় না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ম্যালেরিয়ার প্রধান লক্ষণ হল আক্রান্ত হলেই কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসবে। কখনও জ্বর কমে যাবে কখনও আবার তীব্র জ্বর আসবে। সেই রকম হলে সন্দেহ করা হয় আক্রান্তের ম্যালেরিয়া হয়েছে। জ্বর হলে কোন প্রাথমিক প্রতিষেধকের উপরে ভরসা না রেখে আগে চিকিৎসকের কাছে যান। তার পরে রক্ত পরীক্ষা করালে তবেই ম্যালেরিয়া ধরা পরবে এবং উপযুক্ত চিকিৎসা হবে।
চিকুনগুনিয়া
ডেঙ্গির মতোই চিকুনগুনিয়ারও বাহক বা ভেক্টর হল মশা। এডিস ইজিপ্টাই ও এডিস অ্যালবোপিক্টাস মশা এই রোগের বাহক। তবে ডেঙ্গির সঙ্গে এর উপসর্গে ফারাক আছে। প্রথম দিকে ভাইরালের ফিভারের মতোই খুব জ্বর এবং গা হাত পা ব্যথা থাকে। জ্বর বাড়লে সারা গায়ে র্যাশ বের হয়। হাঁটুর ব্যথা প্রচণ্ড ভোগায়। হাঁটতে গেলে যন্ত্রণা হয় রোগীর। এখানেই চিকুনগুনিয়া ডেঙ্গির থেকে আলাদা। এই জ্বরের ক্ষেত্রে শরীরের প্রতিটি অস্থিসন্ধিতে মারাত্মক ব্যথা হয়। যাকে বলে গাঁটে গাঁটে ব্য়থা হয়। সারা শরীর নাড়াতে গেলে কষ্ট হয়।
জিকা ভাইরাস
জিকা ভাইরাসও মশার কামড় থেকে ছড়ায়। এডিস মশা কামড়ালে তার লালা থেকে এই ভাইরাস মানুষের শরীরে ঢুকে পড়ে। জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ হলে প্রথম লক্ষণই হচ্ছে জ্বর, অনেকটাই ডেঙ্গির মতো। আশঙ্কার বিষয় এটাই যে, অনেক রোগীই সাধারণ জ্বরের সঙ্গে জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত জ্বরকে আলাদা করতে পারেন না। চিকিৎসকদের মতে, যদি কোনও রোগীর একটানা এক সপ্তাহ জ্বর, নাক থেকে জল পড়া, মাথা ব্যথার মতো সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করানো দরকার। শুধু তাই নয়, অনেক রোগীর আবার জ্বর, মাথা ব্যথা, নাক থেকে জল পড়ার পাশাপাশি কনজাংটিভাইটিস, গাঁটে ব্যথাও দেখা দিতে পারে।
টাইফয়েড
একটানা দীর্ঘ দিন ধুম জ্বর থাকে। ১০-১২ দিন পরেও তাপমাত্রা না নামলে ডাক্তার দেখাতে হবে। জ্বর ১০৩-১০৪ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠে যেতে পারে। কোনও সময় তা নামলেও খুব ধীরে নামে কিন্তু বাড়ার সময় হু হু করে বাড়ে। সঙ্গে মাথা যন্ত্রণা, বমি ভাব থাকে। অনেকের ক্ষেত্রেই পেটে যন্ত্রণা ও পেট খারাপের উপসর্গ দেখা দেয়। মূলত উচ্চ তাপমাত্রায় দীর্ঘ দিনের জ্বর এর মূল লক্ষণ।
রেসপিরেটারি ভাইরাস
করোনার মধ্যেই এই ভাইরাসের উপদ্রব বেড়েছে। এটিও কোরোনার মতোই আরএনএ (RNA) ভাইরাস। কিছুদিন আগেই অজানা জ্বরের প্রকোপ বেড়েছিল পশ্চিমঙ্গের জেলায় জেলায়। বাচ্চারা বেশি আক্রান্ত হচ্ছিল। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে একটা সময় এই জ্বরের কারণে চিন্তা বেড়েছিল স্বাস্থ্য আধিকারিকদের। এই অজানা জ্বরের কারণ ছিল রেসপিরেটারি সিনসিটিয়াল ভাইরাস (hRSV)।
উপসর্গ: মূলত শ্বাসনালীতে সংক্রমণ ছড়ায় এই ভাইরাস। ছোঁয়াচে, দ্রুত ছড়াতে পারে। একবার শরীরে ঢুকলে ফুসফুসে মারাত্মক সংক্রমণ ছড়ায়। শ্বাস নিতে সমস্যা হয়। শরীরে ভাইরাল লোড বাড়লে প্রবল শ্বাসকষ্টও হতে পারে।
শিশুরা এই ভাইরাসের প্রকোপে পড়লে ব্রঙ্কিওলাইটিস হতে পারে, বড়দের নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখা দেয়। ধুম-জ্বর, সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্ট, শ্বাসনালীতে প্রদাহ হলে দেরি না করিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে নেওয়া ভাল। কারণ বেশি বাড়াবাড়ি হলে অসুখ নিউমোনিয়ার পর্যায়ে চলে যেতে পারে।