
উচ্চ রক্তচাপে চাপ নেবেন না, সতর্কতাই দাওয়াই, খুঁটিনাটি বোঝালেন বিশেষজ্ঞরা
দ্য ওয়াল ব্যুরো: বুকের কাছে চিনচিনে ব্যথা? প্রেশার মাপলেই চক্ষু চড়কগাছ? নীচের দিকের প্রেসার ৯০ ছাড়িয়েছে, আর ওপরের ১৪০? তাহলেই সতর্ক হতে হবে ঝটপট। গাফিলতি ডেকে আনতে পারে বিপদ। রক্তচাপ ঊর্ধ্বে উঠলে মানসিক চাপ বাড়িয়ে লাভ নেই, বরং সচেতনতাই দাওয়াই। করোনা কালে উচ্চ রক্তচাপ মহা বিপদের কারণ। তাকে বশে রাখার নিয়ম শেখালেন বিশেষজ্ঞরা।
হাইপারটেনশন মানে হল উচ্চ রক্তচাপ (হাই ব্লাড প্রেসার)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র হিসেবে পৃথিবীর প্রায় ১৫০ কোটি মানুষ হাইপারটেনশন নিয়ে বেঁচে আছেন। রক্তচাপ বেড়ে হার্ট অ্যাটাক বা ব্রেন স্ট্রোকে প্রতি বছরই ৭০-৮০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। অনেক সময়েই রোগের লক্ষণ বোঝা যায় না। আচমকাই বুকে ব্যথা, হৃদপিণ্ডে ধড়ফড়, তারপর সব শেষ। রক্তচাপ বশে না রাখলে একে একে বিকল হবে হৃদযন্ত্র, কিডনি, মস্তিষ্ক, চোখ-সহ শরীরের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশিরভাগ রোগী জানেনই না যে তাঁদের রক্তচাপ বাড়তে বাড়তে বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই কোনও শারীরিক অসুবিধা না থাকলেও বছরে এক বার হেল্থ চেক আপের সময় ব্লাড প্রেশার মেপে নেওয়া দরকার। নিজে সচেতন হলেই হবে না, পারিপ্বার্শিক মানুষজনকেও সতর্ক করতে হবে। রোগের লক্ষণগুলো চিনে রাখতে হবে। সামান্য উপসর্গ দেখা গেলেই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। এ বছরে বিশ্ব হাইপারটেনশন দিবসে সেটাই পই পই করে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
উচ্চ রক্তচাপ কখন হয়?
যে কোনও সুস্থ ব্যক্তির স্বাভাবিক রক্তচাপ হওয়া উচিত ১৩০/৮০। সেটা বয়স বা লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলেরই জন্যই প্রযোজ্য। কিন্তু যদি এই রিডিং বদলে ১৪০ বা তার বেশি হয়ে যায় তখনই চিন্তার কারণ রয়েছে। প্রেশার যদি ১৪০/৯০এর বেশি হয়, তখন রক্তচাপ বেড়েছে বলা যায়। হাইপার টেনশন (হাই ব্লাড প্রেশার) ও হাইপো টেনশন (লো ব্লাড প্রেশার)-এর মধ্যে হাইপার টেনশনের সমস্যাই বেশি দেখা যায়।
হাইপারটেনশন তখনই হয়, যখন শরীরের রক্তজালকগুলোর মধ্যে চাপ বাড়ে। আমাদের হৃদপিণ্ড হল পাম্পিং মেশিন। যে তার ছন্দে সঙ্কুচিত ও প্রসারিত হয়ে সারা শরীরে রক্ত সঞ্চালন করেন। এই রক্ত শরীরের নানা কোষে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ছড়ায় রক্তজালকের মাধ্যমে। কোনও কারণে যদি এই জালকের প্রাচীরে অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয়, তখন হৃদপিণ্ড স্বাভাবিকভাবে রক্ত সঞ্চালন করতে পারে না। তখনই বুকে ব্যথা, বুক ধড়ফড় ইত্যাদি নানা লক্ষণ দেখা যায় রোগীর। রক্তচাপ বিপদসীমা ছাড়ালে শরীরে অন্যান্য অঙ্গগুলো বিকল হতে শুরু করে।
ডাক্তাররা বলেন, ব্লাড প্রেসার বা রক্তচাপকে দুভাগে ভাগ করা হয়–এসেনশিয়াল আর সেকেন্ডারি। প্রাইমারি বা এসেনশিয়াল হাইপারটেনশন কেন হয় তার সঠিক কারণ এখনও ধরা যায়নি। ডাক্তাররা বলেন, দীর্ঘ বছর ধরে ধীরে ধীরে এই অবস্থা তৈরি হতে পারে। তবে সেকেন্ডারি হাইপারটেনশনের কিছু কারণ চিহ্নিত করা গিয়েছে। যেমন—অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া, কিডনির রোগ, অ্যাড্রেনাল গ্রন্থির টিউমার, থাইরয়েড ইত্যাদির কারণে রক্তচাপ বাড়তে পারে। তাছাড়া কয়েকরকম ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকেও সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন মাথা চাড়া দিতে পারে। নেশার জিনিস নিয়মিত খেলে এই রোগের ঝুঁকি বাড়ে।
কীভাবে সতর্ক থাকবেন
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক রোগীরই হাইপারটেনশনের কোনও লক্ষণ বোঝা যায় না। সেক্ষেত্রে নিয়মিত হেলথ চেক আপ করাতে হবে, প্রেশার মাপতে হবে নির্দিষ্ট সময় অন্তরে।
করোনা কালে হাইপারটেনশন সবচেয়ে বড় চিন্তার কারণ। তাই সতর্ক থাকতেই হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিছু রোগীর মাথা ঘোড়া, হাল্কা শ্বাসের সমস্যার মতো উপসর্গ দেখা যায়। সামান্য পরিশ্রমে নিঃশ্বাসের কষ্ট ও বুক ধড়ফড় করে। হঠাৎ করেই রাগ হয়, মাথা ঝিমঝিম করতে পারে। অনেকেই এমন উপসর্গ নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে চান না। তাই অসুখ চট করে ধরা পড়ে না। কিন্তু লাগাতার অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ নিয়ে জীবনযাপন করলে কিডনি, হার্ট-সহ বিভিন্ন অঙ্গ একে একে বিকল হতে শুরু করে। আমাদের দেশে হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম কারণ অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ। যার প্রভাব পড়ে মস্তিষ্কেও। আচমকাই রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যেতে পারে, ব্রেন স্ট্রোকে মৃত্যু হতে পারে রোগীর।
আগে মনে করা হত ৪০ উর্ধ্বরাই হাইপারটেনশনে ভোগেন। এখন কমবয়সীদের মধ্যেও এই রোগ বাসা বেঁধেছে, যার কারণ খাদ্যাভ্যাস, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের ও ৪০ উর্ধ্বদের নিয়ম করে ব্লাড প্রেশার চেক করাতেই হবে। বছরে অন্তত একবার হেলথ চেকআপের সময় প্রেশার মাপিয়ে নেওয়া ভাল।
পরিবারে কারও হাই কোলেস্টেরল বা হাইপারটেনশনের ইতিহাস থাকলে ঝুঁকি আছে। সেক্ষেত্রে লাইফস্টাইল ম্যানেজমেন্ট জরুরি। অতিরিক্ত ধূমপান না করাই ভাল, অ্যালকোহলের নেশায় লাগাম টানতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ, সোডিয়াম সমৃদ্ধ খাবার কম খেলেই হবে। কারণ বয়স্ক ব্যক্তিদের সিংহভাগ হাইপোনাট্রিমিয়া-র সমস্যায় আক্রান্ত হন। তাই নুন খাওয়া কমানোই ভাল। জাঙ্ক ফুড, অতিরিক্ত তেলমশালাদার খাবারে রুচি বদলানো দরকার। ডায়েটে পটাসিয়াম সমৃদ্ধ ফলমূল রাখা ভাল, সবুজ শাকসব্জি শরীরে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজের চাহিদা পূরণ করে।
ইউরিক অ্যাসিড, কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাডের মাত্রা যাদের বেশি তারা হাই রিস্ক গ্রুপে আছেন। সেক্ষেত্রে ওষুধ ও লাইফস্টাইল মডিফিকেশন করে প্রেশার কমিয়ে রাখা উচিত। প্রত্যেক ছয় সপ্তাহ অন্তর ডাক্তারের কাছে চেকআপ করানো দরকার।