ঠোঁটের তাপে বয়ঃসন্ধি, ধূমপানে বেশি আসক্ত মহিলারা! অনিয়মিত ঋতুস্রাব, বাড়ছে বন্ধ্যত্বও

পুরুষদের থেকেও সিগারেটে মহিলাদের আসক্তি বেশি। কমবয়সীদের মধ্যে বাড়ছে ধূমপানের প্রবণতা। ঝুঁকি বাড়ছে বন্ধ্যাত্বের, গ্রাস করছে মানসিক অবসাদ।

চৈতালী চক্রবর্তী

হাতে দামি সিগারেট। সুখটানেই বাজার কাঁপাচ্ছে বয়ঃসন্ধি। বারোর কিশোরী হোক বা আঠেরোর টিনএজ ধোঁয়ার রিঙেই বন্দি স্টাইল স্টেটমেন্ট। ম্যানিকিওর করা এক হাতে দামি মোবাইল ও অন্যহাতে সিগারেট না থাকলে ঠিক ‘ডিজিটাল’, ‘ডিজিটাল’ ফিলিং আসে না। স্বাস্থ্য সচেতন ছিপছিপে মেয়েটা ডায়েটের থালায় ভাজাভুজি রাখতে নারাজ, কিন্তু ফেলুদা স্টাইলে সিগারেট ধরিয়ে আয়েশ করে টান দেওয়ার মধ্যেই স্মার্টনেস খুঁজে পায়। ধূমপান ঠিক কতটা ক্ষতিকর সেটা সার্চ ইঞ্জিনের রমারমার যুগে আলাদা করে বলার কিছু নেই। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, পুরুষদের তুলনায় ধূমপানে বেশি আসক্ত মহিলারা। বিশেষত কমবয়সী মেয়েদের মধ্যে সুখটান দেওয়ার প্রবণতা সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।

স্কুল পালিয়ে সিগারেট ফোঁকার অভ্যাস ছিল এককালে। তবে সেটা মাঝেসাঝে, লুকিয়ে। এখন সেই অভ্যাসটাই ক্রনিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে ১২ থেকে ১৮-১৯ বছর, অন্যদিকে ২৫ থেকে ৩০ বছর, ধূমপানে পুরুষদের রীতিমতো টেক্কা দিচ্ছেন মহিলারা। মধ্য চল্লিশের মহিলারাও পিছিয়ে নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু)রিপোর্ট বলছে, মাত্রাতিরিক্ত ধূমপানে বয়ঃসন্ধিতেই অনিয়মিত হচ্ছে ঋতুস্রাব। মহিলাদের মধ্যে বাড়ছে হৃদরোগের ঝুঁকি। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বন্ধ্যত্ব।

কী মণি-মুক্তো লুকিয়ে আছে সিগারেটে?

নেট সার্ফিংয়ে যাঁরা অভ্যস্ত তাঁদের কাছে এই তথ্যগুলো নতুন নয়। তবুও মাঝে মাঝে আর একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া দরকার, একটা টান দেওয়ার পরে ঠিক কী কী ঢুকছে শরীরে। সিগারেটের উপাদানে আছে আর্সেনিক, টয়লেট ক্লিনারে ব্যবহৃত অ্যামোনিয়া, কীটনাশক ডিডিটি, নেলপলিশ রিমুভার অ্যাসিটোন, ব্যাটারিতে ব্যবহৃত ক্যাডমিয়াম, নিকোটিন-সহ আরও প্রায় ৭০০০ রকমের বিষ!

সিগারেট  ও তামাক সেবনকারীদের নিয়ে এক ন্যাশনাল সার্ভেতে জানা গেছে, কলকাতায় ধুমপায়ীর সংখ্যা সবথেকে বেশি। কলকাতায় ৪৯% এবং দেশের বাকি অংশে ৪৩%। আর এই ৪৯ শতাংশের মধ্যে অনেকটাই জুড়ে রয়েছেন মহিলারা।

দামি সিগারেট হাতে বাজার কাঁপাচ্ছেন মহিলারাই

মার্কিন মুলুকে জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ মহিলাই সিগারেটে আসক্ত। তবে এই সমীক্ষাটা ছিল এক বছর আগের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংখ্যা এখন আরও বেড়েছে। ইউনিভার্সিটি অব শেফিল্ডের গবেষকরা বলছেন, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪৭ শতাংশ মহিলা ধূমপানের কারণে নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। শুধু ক্যানসার নয়, হরমোনের সমস্যা থেকে স্ত্রীরোগ সবই ছিল। ২০০৫-২০১০ পর্যন্ত মহিলাদের মধ্যে ধূমপানের আসক্তি বেড়েছে ১.৪%-২.৯%। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট বলছে, শুধুমাত্র সুখটানে আসক্তির কারণেই ফি বছর বিশ্বে এক লক্ষেরও বেশি মহিলার মৃত্যু হয়। ২০২৫ সালে গিয়ে এই আসক্তি আরও ২০ শতাংশ বাড়বে বলেই মত গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোবাকো সার্ভের (Global Adult Tobacco Survey)বিশেষজ্ঞদের।

ভারতীয় মহিলাদের সিগারেটে-আসক্তি চমকে দেওয়ার মতো

এনসিবিআই-পাবমেডের একটি জার্নালে বিজ্ঞানীরা লিখেছিলেন, ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ভারতে মহিলা ধূমপায়ীর সংখ্যা মরাত্মকভাবে বেড়েছে। কমবয়সীরাই সবচেয়ে বেশি নেশার শিকার। সমীক্ষা চালিয়ে এই আসক্তির পিছনে অদ্ভুত কারণও মিলেছে। জেন-ওয়াইদের অধিকাংশেরই বক্তব্য, নিকোটিনের আমেজ কাজে উৎসাহ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্ট্রেস কমিয়ে দিতে পারে। আর এই কারণেই তাঁরা সিগারেটের দাসত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন না। আবার এমনও শোনা গেছে, সিগারেট টানলে নাকি মেদ ঝরিয়ে স্লিম থাকা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই কোনও যুক্তিরই সত্যতা নেই। ১০০ জন ধূমপায়ীর ৯৩ জনই ধূমপানের মারাত্মক দিক সম্পর্কে অবহিত। তাও দিন দিন বাড়ছে সিগারেটে সুখটান দেওয়ার এই অভ্যাস।

ইনস্টিটিউট ফর হেল্থ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন (IHME)-এর সমীক্ষা বলছে, গত দশ বছরে দেশে পুরুষদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা অনেক কমেছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মহিলা ধূমপায়ীর সংখ্যা।


কী ভাবে বাড়ছে মহিলা ধূমপায়ীর সংখ্যা?

কতটা ধূমপানে আসক্ত মহিলারা সেটা জানতে অ্যাসোচাম সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন  (Assocham Social Development Foundation) দেশের বড় শহরগুলিতে একটি সমীক্ষা চালায়। রাজধানী দিল্লি থেকে শুরু করে তিলোত্তমা কলকাতা, হায়দরাবাদ, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, লখনউ, পুণে, মুম্বই, আমদাবাদ ও জয়পুরের প্রায় ২০০০ জন যুবতীর উপর এই পরীক্ষা করা হয়। তাঁদের প্রত্যেকেরই বয়স ২২ থেকে ৩০-এর মধ্যে। সমীক্ষায় দেখা যায়, ৪০ শতাংশ মহিলা বলছেন তাঁরা কম ধূমপান করেন (Light Smokers)। অথচ দিন তিনটের বেশি সিগারেট খান।  ১২ শতাংশ বলছেন তাঁরা সিগারেট খান মাঝেমধ্যে বা দিনে দু’টোর বেশি নয়। বাকিদের দাবি তাঁরা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন, আর তো মাত্র ক’টা দিন। অতএব, সুখটান দেননি বা দিচ্ছেন না এমনটা একদমই নয়।

ধূমপানে আসক্ত কৈশোর

• সমীক্ষা বলছে, ভারতে  প্রায় ৯ কোটি পুরুষ ও ১.৩ কোটি মহিলা ধূমপান করেন।

• কলেজছাত্রীদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে। এদের মধ্যে ২৭% প্রতি  দিন ৫–১০টি সিগারেট টানেন।

• ১৯৮০ সালে ৫৩ লক্ষ মহিলা ধূমপায়ী ছিলেন। ২০১২ সালে সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১.২৭ কোটিতে। ক্রমশ বাড়ছে মহিলা ধূমপায়ীর সংখ্যা।

• ১৯৮০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে পুরুষ ধূমপায়ীর সংখ্যা ৩৩.৮% থেকে কমেছে ২৩%। অথচ প্রতি ২০ জন মহিলার মধ্যে একজন অর্থাৎ প্রায় ৬% বেড়েছে মহিলা ধূমপায়ীর সংখ্যা।

সুখটানই বাড়াচ্ছে অসুখ, মহিলারা শুনছেন তো?

এটা বলাই বাহুল্য, কারণ সিগারেটের কু-প্রভাব সম্পর্কে আলাদা করে বলার কিছু নেই। তবে যেহেতু মহিলাদের শরীরের গঠন পুরুষদের থেকে অনেক আলাদা তাই ক্ষতির পরিমাণটাও অনেক বেশি। এবং রোগও ধরে যায় চটজলদি। এমনটাই জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা।

• প্রথমত বিদ্রোহ ঘোষণা করে শরীরের সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হৃৎপিণ্ড। রক্ত সঞ্চালন কমে গিয়ে বাড়ে হৃদরোগের সম্ভাবনা।

• ফুসফুসের রোগ, হাঁপানি তো আছেই, সামান্য জ্বরও লাগাম ছাড়িয়ে বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।

• ঋতুস্রাব হয়  অনিয়মিত, অকালেই মেনোপজ এবং নানা স্ত্রীরোগের সমস্যা দেখা দেয়।

• গর্ভপাত থেকে বন্ধ্যাত্ব ধূমপানের মারাত্মক ক্ষতিকর দিক। Pelvic Inflammatory Disease (PID) হওয়ার সম্ভাবনাও দেখা দেয়।

• ধূমপানে বাড়ে পেরিফেরাল ভাস্কুলার ডিজিজের আশঙ্কা। অর্থাৎ পা-সহ শরীরের বিভিন্ন অংশের রক্তবাহী ধমনিতে কোলেস্টেরলের প্রলেপ জমে রক্ত চলাচল কমে যায়। সব থেকে বেশি সমস্যা হয় পায়ে। ধূমপায়ীদের এই অসুখের আশঙ্কা অন্যদের থেকে ১৬ গুণ বেশি। মধ্য বয়সে পেরিফেরাল ভাস্কুলার ডিজিজ জনিত পায়ের ব্যথার রোগীদের ৯৫% ধূমপায়ী।

• নেশার থেকেও বেশি মাথা চাড়া দেয় মানসিক সমস্যা।

যে ভাবে বাড়ছে মহিলা ধূমপায়ীর সংখ্যা তাতে নেশার থেকেও বেশি রয়েছে অন্য একটি কারণ। সেটা পুরোপুরিই মানসিক। এমনটাই মত মনোবিজ্ঞানীদের। হালফিলের লাইফস্টাইলে ‘প্যাশন’ শব্দটার একটা অন্য মানেই বার করে ফেলেছে জেন এক্স ও ওয়াই। এই প্যাশন হল নিজের জাহির করার। নামী সংস্থায় চাকরি বা গাড়ি হাঁকিয়ে শপিং করা তরুণীর কাছে প্যাশনের অর্থ সাহেবিয়ানাকে উস্কে দেওয়া। মেয়েরাও ছেলেদের থেকে কমতি নয় এটা দেখাতে গিয়েই সবার মাঝে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট এবং দামি লাইটার ব্যাগ থেকে বার করার মধ্যেই আনন্দ খুঁজে পাচ্ছেন মেয়েরা। এটাই তাদের কাছে স্বাধীনতা। ভিড়ের মধ্যেও একটু আলাদা থাকার প্রচেষ্টা। ‘আমি সিগারেট খাচ্ছি, না সিগারেট আমাকে’ এই কথার সত্যতা যদি জানাই থাকে তাহলে আর কেন। বরং বলা ভাল, অনেক তো হল। এ বার না হয় সিগারেটটা ছেড়েই দিন। কী ভাবছেন মেয়েরা?