
পার্থ ১০৮ কেজি, অনুব্রত ১১০, হেভিওয়েট নেতারা এত হেভি কেন জানাচ্ছেন ডাক্তাররা
গুড হেলথ ডেস্ক
‘মনে রেখো বড়ো মাপে করা চাই আয়োজন, কলেবর খাটো নয়, তিন মোন প্রায় ওজন’..
এই দামোদর শেঠরা অল্পেতে খুশি নয়। এদের রসনা তৃপ্তির জন্য ‘মুড়কির মোয়া চাই,
চাই ভাজা ভেটকি’। খাওয়াদাওয়া, বিলাসব্য়সনের আড়ম্বর এতটাই যে ওজন আর বশে থাকতেই চাইছে না। ভুঁড়ি বাড়ছে বেলুনের মতো, কোলেস্টেরলে কুপোকাৎ, হাইপারটেনশনে হাঁসফাঁস (Partha Anubrata)। তার ওপর অর্শ, শ্বাসকষ্ট বাদ যাচ্ছে না কিছুই। বডি-মাস-ইনডেক্স দেখে ডাক্তারদেরই ভিড়মি খাওয়ার জোগাড়। উঠতে-বসতে শরীর যেন গড়িয়ে যাচ্ছে। বডি ব্যালান্স বলে কিছু নেই। কেউ নিজে থেকে স্নান করতে পারেন না, তো কারও রাতে ঘুমই আসে না, এতটাই ইনসমনিয়া। কেউ তো আবার ভুঁড়ি বাঁচিয়ে নীচু হয়ে জুতোর ফিতেটাও বাঁধতে পারেন না। তার জন্যও পুলিশ, দেহরক্ষীদের ডাক দিতে হয়। দেখলে মনে হবে, এদের “জলপানি তিনটি ধামা পেস্তা মেওয়া, সঙ্গেতে তার চৌদ্দ হাঁড়ি দৈ কি মালাই মুড়কি দেওয়া।”
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। রাজ্য রাজনীতি সরগরম করে তোলা হেভিওয়েট দুই নেতার কথাই বলা হচ্ছে। একদিকে পার্থ চট্টোপাধ্যায়, অন্যদিকে বীরভূমের জেলা কাঁপানো অনুব্রত মণ্ডল (Partha Anubrata)। দু’জনেই তৃণমূলের হেভিওয়েট নেতা। আর দু’জনেই আড়েবহরে ‘হেভি’। পার্থর ওজন ১০৮ কেজি, আর অনুব্রত ১১০ কেজি ছাড়াব ছাড়াব করছেন।
রাজনীতি বা এই নেতাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ, মামলা নিয়ে কোনও কথা হচ্ছে না। কথা হচ্ছে এই এতটা ওজন নিয়ে। সে লালুপ্রসাদ যাদব হোক বা বাংলার অনুব্রত মণ্ডল–রাজনীতিকদের এহেন ভারী চেহারার কারণটা কী! তার মানে এই নয় সকলেরই বিশাল বপু। অনেকেই ভাল রকম স্বাস্থ্য সচেতন। একসময় ভারী চেহারা থাকলেও এখন ওজন কমিয়ে ফেলেছেন অনেকেই। আবার কিছু লোকজন এতটাই ভোগবিলাসে আলস্যে ছিলেন যে ওজন কমা তো দূর, বরং তা রকেট গতিতে বেড়েছে দিনের পর দিন।
আড়েবহরে এত ‘ভারী’ কেন নেতারা
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডাক্তার ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রথম কথা হল সীমাহীন ভোগবিলাস। তাতে কোনও নিয়ন্ত্রণই নেই। এত বেশি বিলাসিতাই চরম আলস্য ডেকে এনেছে। এঁরা ভোটের সময় প্রচারে যতটা পরিশ্রম করেন, শারীরিকভাবে ততটা পরিশ্রম করলে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকত অনেকটাই। সুতরাং আলসেমি এবং শরীরচর্চায় অনীহা ওজন বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
দ্বিতীয়ত হচ্ছে খাওয়াদাওয়ায় কোনও লাগাম নেই। পার্থ চট্টোপাধ্য়ায় জেলে শুকনো রুটি চিবোতে চাননি। মুচমুচে চপ খাওয়ার জেদ ধরেছিলেন। রবিবারের দুপুরে গরম গরম পাঁঠার মাংস দিয়ে ভাত খাওয়ার বায়না জুড়েছিলেন। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, স্বাস্থ্য নিয়ে এঁরা একেবারেই সচেতন নন। ‘গণ্ডা দশেক মণ্ডা ছাড়া’ ছাড়া এঁদের খুচরো খিদে মেটে না, আবার সন্ধে হলেই ‘দিস্তা দিস্তা লুচির তাড়া’ চাই। এমন খাওয়ার বহর হলে চেহারা তো আড়েবহরে বাড়বেই।
তিন নম্বর কারণ হল, অতিরিক্ত চিন্তা, টেনশন। বেশিরভাগকেই পরীক্ষা করলে দেখা যাবে কোনও না কোনওভাবে রক্তচাপ বেশি, মাত্রাতিরিক্ত স্ট্রেস ও হাইপারটেনশন রয়েছে বেশিরভাগেরই। অ্য়াংজাইটিতে ভোগেন অনেকেই। এই মানসিক চাপ শরীরেও মারাত্মক প্রভাব ফেলে। বাড়তি স্ট্রেস মেটাবলিক সিনড্রোমের কারণ। আর মেটাবলিক সিনড্রোম ওবেসিটির অন্যতম রিস্ক ফ্যাক্টর।
মেটাবলিক সিনড্রোমের কথাই যদি ওঠে, তাহলে বলতেই হয় বাংলার এই দুই নেতাও তাতে ভুক্তভোগী। আমরা সারাদিন যা যা করছি, কী খাচ্ছি, কতটা শরীর নাড়াচাড়া করছি, কতটা সংযম রাখছি রোজকার যাপনে, এই সবকিছুই কিন্তু মেটাবলিক সিনড্রোমের সঙ্গে জড়িত। সেটা কী? ধরা যাক রক্তের গোলমাল যেমন কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি, খারাপ কোলেস্টেরল স্তরে স্তরে জমছে, ট্রাইগ্লিসারাইড বাড়ছে, গ্লুকোজের পারদ চড়ছে, ইউরিক অ্যাসিড জমছে আর পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রক্তচাপ। এই সবকিছুই কিন্তু একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইড বেড়ে যাওয়া, ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া সব মিলিয়ে যে রোগের জন্ম দিচ্ছে তাই হল মেটাবলিক সিনড্রোম। এটা একদিকে যেমন ওজন বাড়াচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে হার্টেও প্রভাব ফেলছে। তাই ঘন ঘন বুকে ব্যথা, শরীরে অস্বস্তি, হাঁসফাঁস এইসব উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। মাঝে মাঝেই মেডিক্যাল টেস্টের জন্য হাসপাতালে ঘুরিয়ে আনতে হচ্ছে নেতাদের।
ওজন বাড়ার আরও একটা কারণ হল নেশা। এখন কে কেমন নেশা করেন তা জানা নেই। তবে যদি অ্যালকোহলে আসক্তি থাকে তাহলে মেদ বাড়বেই। সেক্ষেত্রে ফ্য়াটি লিভার থেকে ওজন বৃদ্ধির সম্ভাবনা থেকে যাবে।
এ তো গেল ওজন বাড়ার কারণ। এবার ফলাফলে আসা যাক। অনুব্রত বলেছিলেন তাঁর ফিসতুলার সমস্যা আছে। পার্থর শরীরের ব্যালান্সই ঠিক নেই। কেউ না ধরলে উঠতে বসতে সমস্যা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভুঁড়ি বাড়লে ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়েরিয়া, অ্যাসিডিটির সমস্যা হয়। এগুলোর বেশির ভাগেরই কারণ ক্ষুদ্রান্ত্রে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ। অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস ও পাকস্থলীর অ্যাসিডের ঘাটতির জন্য এমনটা হয়ে থাকে। অনুব্রত মণ্ডলের মেডিক্য়াল টেস্টে ধরা পড়েছে তাঁর রক্তচাপ বেশি, অবস্ট্রাকস্লিপ অ্যাপনিয়াও আছে। অতিরিক্ত ওজনই এসবের কারণ।
জেলে থেকে সুরাহা কি কিছু হবে?
সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেন জেলে বছরখানেক কাটিয়ে একেবারে স্লিম ট্রিম হয়ে বেড়িয়েছিলেন। ধরা পড়ার আগে বেশ নাদুসনুদুসই গড়ন ছিল তাঁর। অনেকেই মনে করছেন, জেলের নিয়ম, খাওয়ার ধরন, কঠোর অনুশাসনেই ওজন কমে যাবে হুড়মুড়িয়ে। তেল চকচকে ভুঁড়ি গায়েব হবে অচিরেই।
যে পার্থ চট্টোপাধ্যায় রবিবাসরীয় দুপুরে মটন-ভাত খেয়ে ভাতঘুম দিতেন, তিনি এখন জেলে রুটি-তরকারি খাচ্ছেন। সন্ধে বেলায় চাট্টি মুড়ি পাচ্ছেন, অবশ্যই চপ ছাড়া। এমন রুটিন চলতে থাকলে ওজন কমবে বইকি।
তবে এই বিষয়ে অন্যকথাও বলছেন বিশেষজ্ঞরা। জেলে হেভিওয়েট নেতাদের জন্য ভারী বন্দোবস্তই থাকে। যদি জামাই আদরেই রাখা হয় তাঁদের তাহলে সুরাহা কতটা হবে জানা নেই। আর যদি সংশোধনাগারের কঠোর অনুশাসন সকলের জন্যই একইরকম হয় তাহলে বিলাসিতা আর আলস্য, দুইই বাদ যাওয়ায় চেহারায় বদল আসতে বাধ্য।