হাঁপানির টানে হাঁসফাঁস, ঠান্ডা বাড়লেই হাঁচি-শ্বাসকষ্ট, এই করোনা কালে কীভাবে সুস্থ থাকবেন

দ্য ওয়াল ব্যুরো:  ঠান্ডা কখনও কম, কখনও বেশি। এই পারদ নামছে ১১ ডিগ্রিতে, তো পরদিনই বনবন করে পাখা ঘোরাতে হচ্ছে। জ্বালাতনের শেষ নেই। খামখেয়ালি আবহাওয়ার সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে শরীরে নাজেহাল দশা। সিজন চেঞ্জে যেমন ভাইরাল জ্বর কাবু করছে, তেমনি ঠান্ডা-গরমে হেঁচে-কেশে অস্থির। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো আছে হাঁপানি। একবার টান উঠলে আর দেখতে হবে না। বুকে যেন পাথর চেপে বসছে। কখনও চিনচিনে ব্যথা, কখনও দমবন্ধ, হাঁসফাঁস অবস্থা। ঘুমোতে গেলেই বুকের ভেতর সাঁই সাঁই। শ্বাস নিতে গেলে কাশির দমকে অস্থির। ঘন ঘন বুকে কফ,  লাগামছাড়া হাঁচি, টান, অ্যালার্জি, ইনহেলার—একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা!

হাঁপানি বা অ্যাজমা অতি বিষম বস্তু। আক্রান্তেরা এর যন্ত্রণা বিলক্ষণ জানেন, আর যাঁরা অল্প ঠান্ডাতেই হাঁচি-কাশি-শ্বাসকষ্টে অস্থির তাঁরা মুঠো মুঠো ওষুধ খেয়ে সাময়িক স্বস্তি পেয়ে ভাবেন, এই তো অর্ধেক রোগ সেরেই গেল, তাঁদের জন্য সতর্কবার্তা– হাঁপানিকে মোটেও খাটো করে দেখা উচিত নয়। এর ছোবল থেকে নিস্তার নেই, শুধু বশে রাখা সম্ভব। আর অবহেলা করলে ফল হতে পারে প্রাণঘাতী।

গোটা দেশেই দূষণ যেভাবে বাড়ছে তাতে হাঁপানি আরও প্রবলভাবে আসর জমিয়ে বসছে। দীপাবলি, ছটপুজোতে আতসবাজির বাড়বাড়ন্ত পেরিয়ে এখন শীতের কুয়াশা, গাড়ির ধোঁয়া, ফুলের রেণু, কালো ছায়ার মতো কার্বন-মনোক্সাইড সব মিলিয়ে প্রাণভরে শ্বাস নেওয়ার রাস্তাটুকুও বন্ধ। আর এই শীতে যেভাবে কুয়াশার দাপট বেড়েছে, আর তার সঙ্গে ধুলো-ধোঁয়া মিলে ধোঁয়াশা তৈরি করেছে, তাতে শ্বাসের সমস্যা বেড়েছে বই কমেনি।

শিশু হোক বা বয়স্ক, অ্যাজমার টান ওঠা মানেই আতঙ্গ। হাতের কাছে ইনহেলার না থাকলে আরও বিপদ। অল্প হাঁটলেই বুকে ব্যথা, ঘুমোতে গেলেই বুকের ভেতর যেন সাইরেন বাজছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন হাঁপানি কখনও একেবারে সাড়ে না। এর প্রকোপকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, তার জন্য সামান্য কিছু নিয়ম মানলেই চলে। ওষুধের থেকে ঘরোয়া টোটকা সহজলভ্য আর আরামও মেলে বেশি।

The New Chinese Medicine to Relieve Asthma Symptoms - Spark Health MD
হাঁপানি হানা দেয় কেন
?

হাঁপানি বা অ্যাজমা (Ashthma) হয় মূলত শ্বাসনালীতে প্রদাহের কারণে। দীর্ঘকালীন প্রদাহের ফলে শ্বাসনালীর স্বাভাবিক ব্যস কমে যায় এবং সংবেদনশীলতা বাড়ে। ফলে ফুসফুসের ভিতর বায়ু ঢোকা ও বেরনোর পথ সংকীর্ণ হয়ে যায়। শ্বাসনালীর ভেতর মিউকাসের ক্ষরণ বাড়তে বাড়তে সেটা আরও সঙ্কুচিত হতে থাকে। সঠিক চিকিৎসা না হলে শ্বাসনালী পুরোপুরি অবরুদ্ধ হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। চিকিৎসকরা অনেক ক্ষেত্রেই বলেন অ্যাজমা বংশগত কারণে হতে পারে। তবে বর্তমান সময়ে যেভাবে ধুলো-দূষণ বাড়ছে তাতে হাঁপানির সমস্যা এখন ঘরে ঘরে। আরও কিছু কারণে হাঁপানির টান বাড়তে পারে।

Asthma: Causes, Symptoms, And Treatments | Elmwood Hills Healthcare Center Blog
হাঁপানির লক্ষণ—টান কি বাড়ছে?

হাঁপানির লক্ষণ এক একজনের ক্ষেত্রে এক একরকমের। পালমোনোলজিস্টরা বলেন, সাধারণত অল্পেই হাঁপ ধরা, বুকে ব্যথা, শ্বাস নিতে গেলে সমস্যা, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাশি হওয়া, অনবরত হাঁচি, শ্বাস নিতে ও ছাড়তে গেলে বুকের ভেতর সাঁই সাঁই শব্দ, চোখ দিয়ে ক্রমাগত জল পড়া, চোখে জ্বালা—এইসবই হাঁপানির উপসর্গ। হাঁপানির সমস্যায় কখনও আগে টান ওঠে, পরে অন্যান্য লক্ষণ দেখা দেয়। আবার ঠিক এর উল্টোটাও হতে পারে।

কী কী কারণে টান বাড়তে পারে–ফ্লু, নিউমোনিয়া জাতীয় শ্বাসযন্ত্রের কোনও রোগের ইতিহাস থাকলে ঠান্ডা বাড়লেই হাঁপানির টান বাড়তে থাকে।

ভাইরাসের সংক্রমণ, ভাইরাল জ্বরে হাঁপানির সমস্যা অনেক বাড়ে।

মেদবাহুল্য, অধিক পরিশ্রম, বেশি হাঁটাচলার কারণে টান বাড়তে পারে।

পরিবেশ দূষণ অন্যতম কারণ। গাড়ির ধোঁয়া, বাতাসের ক্ষতিকর গ্যাস, স্মগ শ্বাসের সমস্যা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। অনেককেই পেশাগত কারণের জন্য রাসায়নিক বা ধুলো-ধোঁয়ার মধ্যে থাকতে হয়। সেক্ষেত্রে বিশেষভাবে সতর্ক থাকা উচিত।

Asthma Symptoms and Triggers | Allergy & Asthma Network

অ্যালার্জি থেকে বা অ্যালার্জি ইনডিউসড অ্যাজমায় আক্রান্ত হন বহু মানুষ। বাতাসে থাকা ফুলের রেণু, পোকামাকড়, বিশেষ কোনও খাবার, বালিশ, লেপ তোশকের ধুলো, পোষ্যের লোম ও স্যালাইভা, কোল্ড ড্রিঙ্ক—যে কোনও কিছু থেকে অ্যালার্জি হতে পারে।

বিটা ব্লকার, অ্যাসপিরিন ও কিছু পেনকিলার অ্যাজমার সমস্যা বাড়ায়।

মানসিক চাপ থেকেও রোগের উপসর্গ বাড়ে।

কোনও কোনও মহিলা ঋতুস্রাবের আগে অ্যাজমার টানে ভোগেন। প্রোজেস্টেরন হরমোনের মাত্রা কমে যাওয়ার ফলে এমনটা হয়।

How Does the Weather Affect Asthma?

হাঁপানিতে বিষম জ্বালা শ্বাসকষ্ট, তবে সব শ্বাসকষ্ট কিন্তু হাঁপানি নয়

বেশিরভাগ শ্বাসকষ্টের জন্য দায়ী ফুসফুসের সমস্যা। অবস্ট্রাকটিভ লাং ডিজিজ হলেই শ্বাসকষ্ট হয়। হাঁপানির সমস্যায় যেমন শ্বাসের টান ওঠে, তেমনি সিওপিডি তথা ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ হলেও শ্বাসকষ্ট হয় রোগীর। হাঁপানি হলে ফুসফুসে হাওয়া ঢোকা–বেরোনোর পাইপ (ব্রঙ্কিওল) সরু হয়ে যায় বলে শ্বাসকষ্ট হয়। আর সিওপিডি মূলত মধ্যবয়স্কদের ক্ষেত্রে হয়। তবে দূষণের মাত্রা যেভাবে বেড়েছে এবং ধূমপানে আসক্তিও বেড়েছে, তাতে কমবয়সীদের মধ্যেও এই রোগ দেখা

প্যানিক ডিজঅর্ডার, অবসাদ  হলেও শ্বাসের সমস্যা হয়। দেখা যায়, উৎকণ্ঠা হলে বা ভয় পেলে প্রায় ২৫ থেকে ৮৩ শতাংশ ক্ষেত্রে একধরনের শ্বাসকষ্ট হতে থাকে, যার কোনও শারীরিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। ঠান্ডা লেগে নিউমোনিয়ার কারমে শ্বাসকষ্ট হতে পারে, আবার হৃদরোগেও শ্বাসের সমস্যা হয়। ইনহেলার নিয়ে শ্বাসকষ্ট না কমলে তখন সতর্ক হতে হবে অবশ্যই।

করোনা কালে শ্বাসকষ্ট অন্যতম প্রধান উপসর্গ। তবে হাঁপানির রোগীদের করোনা ভয় কতটা সে নিয়ে বিজ্ঞানীদের নানা মতামত আছে। হাঁপানি যেহেতু শ্বাসযন্ত্রেরই রোগ আর কোভিড সংক্রমণের সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটারি সিন্ড্রোম দেখা দেয়, তাই হাঁপানি রোগীদের নিয়ে চিন্তা এখনও আছে। তবে গবেষকরা বলছেন, হাঁপানি মানেই যে করোনা সংক্রম  ধরতে পারে এমনটা নয়। তবে হাঁপানি যেহেতু শ্বাসযন্ত্রকে দুর্বল করে দেয় তাই সতর্ক থাকতেই হবে। কারণ দুর্বল হোস্ট মানেই ভাইরাসের বাড়বাড়ন্ত। ঠান্ডা লাগানো চলবে না কোনওভাবেই।

হাঁপানি থাকুক বশে

ঠান্ডা লাগার ধাত থাকলে গরম পোশাক, সোয়েটার, স্কার্ফ সঙ্গে রাখা দরকার। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসে কান-মাথা ভাল করে চাদরে জড়িয়ে বসলে ভাল।

সঙ্গে সবসময় ইনহেলার রাখা জরুরি। ঋতুপরিবর্তনের সময় সর্দিজ্বর হলে হাঁপানির প্রবণতা বাড়ে। অনেক সময় অতিরিক্ত কায়িক পরিশ্রম করলেও টান ওঠে, যাকে ডাক্তারি ভাষায় বলে এক্সারসাইজ ইন্ডিউসড অ্যাজমা। সেক্ষেত্রে ইনহেলার সঙ্গে রাখা প্রয়োজনীয়। ইনহেলারের সাহায্যে ওষুধ নিলে তা সরাসরি শ্বাসনালীতে পৌঁছে যায়। রোগী দ্রুত আরাম পায়।

অ্যালার্জি এই অসুখের এক অন্যতম কারণ। ধুলো, ধোঁয়া, বাতাসে ভেসে থাকা ফুলের রেণু, পোষা পশুপাখির লোম, রান্নাঘর ও বিছানার ধুলো, তুলোর আঁশ ইত্যাদি শ্বাসনালীর প্রদাহ সৃষ্টি করে। এর থেকে হাঁপানির টান বাড়ে। পশু-পাখির রোমে অ্যালার্জি থাকলে ঋতুবদলের সময় পোষ্যদের সঙ্গও এড়িয়ে চললে ভাল হয়।

Cannabis and Asthma: Top 5 Benefits & Do's and Don'ts - Sensi Seeds

গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স বা অ্যাসিডিটি হলে অ্যাজমার কষ্ট বাড়ে। সেক্ষেত্রে খাবারদাবারে সচেতন থাকা প্রয়োজন। গরম চা হাঁপানির টানে উপশমের কাজ করে। গ্রিন টি বা লিকার চা খেলে কষ্ট কমে।

ইউক্যালিপটাস তেল হাঁপানিতে খুব কার্যকর। গরমজলে দু‍‌’ফোটা এই তেল ফেলে ভেপার নিলে উপশম পাওয়া যায়। সর্ষের তেলে বুকে-পিঠে মালিশ করলেও আরাম পাওয়া যায়।

UNPSJB continues with medical and scientific research on the medicinal use of cannabis and its derivatives - Archyde

প্রতিদিন সকালে উষ্ণ গরম জলে পাতিলেবু ফেলে খেলে দূরে থাকবে হাঁপানি। ভিটমিন সি শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে। তাছাড়া বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাতে শোওয়ার আগে এক চামচ মধু খেয়ে শুলেও হাঁচি-কাশি থেকে অনেকটা রেহাই মেলে।

ধূমপান অ্যাজমার ঝুঁকি বাড়ায়। প্যাসিভ স্মোকাররাও কিন্তু সুরক্ষিত নন।

আট থেকে আশি যে কোনও বয়সেই অ্যাজমা হতে পারে। এদের প্রত্যেকেরই উচিত বাধ্যতামূলক ভাবে নিউমোনিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা ও চিকেন পক্সের টিকা নেওয়া। কেননা, হাঁপানির সঙ্গে সঙ্গে নিউমোনিয়া বা চিকেন পক্স হলে রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ার ঝুঁকি থাকে।