
হার্টে সার্জারি আর আতঙ্ক নয়, ১০০% নিরাপদ, সহজ করে বললেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
হার্ট সার্জারি মানেই ভয়ঙ্কর এক ট্রমা। অপারেশন থিয়েটারের বাইরে উত্তেজনার পারদ চড়ে। হৃদপিণ্ডে অস্ত্রোপচার মানেই প্রাণের ঝুঁকি, এমন বদ্ধমূল ধারণা আছে অনেকেরই। হার্ট সার্জারি (Cardiac surgery) মানে আগে ছিল বুকের হাড়ে কাটাছেঁড়া করে অতি দীর্ঘ এক জটিল প্রক্রিয়া। বাইপাস সার্জারির নাম শুনলেই আতঙ্কে বুক কাঁপত রোগীর। কিন্তু এখন অনেক নতুন পদ্ধতি চলে এসেছে যাতে ভয় কম, রোগীও তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন। কার্ডিয়াক সার্জারি নিয়ে অনেক নতুন কথা বললেন নারায়ণ মেমোরিয়াল হসপিটালের কনসালট্যান্ট কার্ডিওথোরাসিক অ্যান্ড ভাস্কুলার সার্জন ডক্টর এমডি রশিদ জেয়া আয়ুবি।
১) কার্ডিয়াক ব্লকেজ, বাইপাস সার্জারির মতো শব্দগুলি বেশিরভাগ মানুষের কাছে অত্যন্ত ভয়ের, এখন কী হার্ট সার্জারি (Cardiac surgery) সত্যিই খুব ভয়ের?
মানুষ খুব ভয় পায়। এখন কার্ডিয়াক সার্জারি ১০০ শতাংশ নিরাপদ। ঠিক প্লেনে ট্রাভেল করার মতোই সহজ ও নিরাপদ।
কার্ডিয়াক থেরাপির অনেক আধুনিক পদ্ধতি সামনে এসেছে। নিত্য নতুন ডিভাইস ব্যবহার করছেন ডাক্তাররা যাতে ঝুঁকি অনেক কম এবং পোস্ট-সার্জারি বা অপারেশনের পরবর্তী সময়ে খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাও সম্ভব হচ্ছে।
২) কার্ডিয়াক সার্জারি কী?
হার্টের কোনও সমস্যা হলেই আমরা ডাক্তার দেখাই। সবক্ষেত্রেই যে অস্ত্রোপচারের দরকার হয় তা নয়। কিছু সমস্যার চিকিৎসা হয় ওষুধ দিয়ে, কিছু ইন্টারভেশনে আবার কিছু জটিল ক্ষেত্রে সার্জারি (Cardiac surgery) করতে হয়। হার্টে ধমনী আছে, সেখানে ব্লক হলে একে ট্রিপল ভেসেল ডিজিজ বলে। এর চিকিৎসা বাইপাস সার্জারি দিয়ে হয়। আবার হার্টের ভাল্বে সমস্যা হলে, লিক করলে সেক্ষেত্রে সার্জারি করতে হয়।
আবার হার্টের গঠনগত কোনও সমস্যা হলে যা জন্মগত যেমন হার্টে ছিদ্র, ভাল্বে লিকেজ হলে তার চিকিৎসা সার্জারি দিয়ে করতে হয়।
৩) কার্ডিয়াক সার্জারি নিয়ে আপনাদের এখানে কী কী কাজ হচ্ছে?
কার্ডিয়াক সার্জারি নিয়ে খুব ভাল কাজ হচ্ছে নারায়ণ মেমোরিয়াল হসপিটালে। অ্যাডাল্ট কার্ডিয়াক সার্জারি বা বড়দের হার্টের কোনও সমস্যায় তার চিকিৎসা খুব ভালভাবই হয় এখানে। হার্টের ধমনী, রক্তজালিকার সমস্যায় খুব ভাল চিকিৎসা হয়। বাচ্চাদের বা পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সার্জারিও খুব ভালভাবে হয় এখানে।
তাছাড়া এখানে এমার্জেন্সি ভাস্কুলার সার্জারি খুব ভালভাবে হয়। থোরাসিক সার্জারিও হয় এখানে। বুকের মধ্যে কিছু সমস্যা হচ্ছে, কফ জমে গেছে, জল জমেছে, ফুসফুসের কোনও রোগ বা ফুসফুসে টিউমার হয়েছে এমন সমস্ত রোগের চিকিৎসা এখানে হয়।
একই সঙ্গে অ্যাডাল্ট ও পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সার্জারি সব জায়গায় হয় না। নারায়ণ মেমোরিয়াল হসপিটালে এই সুবিধা আছে।
৪) নতুন কী কী পদ্ধতি এসেছে? সাফল্যের হার কতটা?
এখানে সমস্ত নতুন পদ্ধতির প্রয়োগ হচ্ছে। আগে বুকের হাড় কেটে বাইপাস সার্জারি হত। এখন সেখানে বুকের হাড় কাটার দরকার পড়ে না। ইদানীংকালে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতিতে হার্ট সার্জারি আর জটিল এবং সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া নয়। আধুনিক পদ্ধতিতে অনেক দ্রুত হৃদপিণ্ডে অস্ত্রোপচার সম্ভব। বেশি যন্ত্রণাও সইতে হয় না। পোস্ট সার্জারি বা অস্ত্রোপচারের পরে খুব কমদিনে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাও সম্ভব। ‘মিনিমালি ইনভ্যাসিভ হার্ট সার্জারি’ এমনই এক উন্নত পদ্ধতি। শুধু বড়দের ক্ষেত্রে নয়, বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও এই পদ্ধতির প্রয়োগ করছেন এখানকার কার্ডিওলজিস্টরা।
মিনিমাল ইনভ্যাসিভ হার্ট সার্জারির সাফল্যের হার খুব বেশি। এর সুবিধা হল, যন্ত্রণা কম। রোগী খুব তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারে। স্বাভাবিকভাবে জীবনও কাটাতে পারেন। প্রাণ সংশয়ের ঝুঁকিও কম।
৫) মাইক্রোসার্জারি বা মিনিমাল ইনভ্যাসিভ সার্জারি কী?
বাইপাসের ক্ষেত্রে যেমন ব্রেস্টবোন ক্র্যাক করার দরকার পড়ে এক্ষেত্রে তা হয় না। খুব ছোট ছিদ্র দিয়ে হার্ট অবধি পৌঁছে যাওয়া যায়। বিশেষত এটা মাইক্রোসার্জারি (Cardiac surgery)। মানে হল স্মল কাট সার্জারি। ৩-৪ ইঞ্চির বেশি ছিদ্র করাই হয় না। এর সুবিধা হল তাড়াতাড়ি ক্ষত সেরে যাবে, রক্তক্ষরণ হবে না। রোগীও তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে পারবেন।
আর এটা তো ঠিকই যে, বুকের হাড় কাটাছেঁড়া মানে তার আফটার এফেক্টস বা প্রতিক্রিয়াও বেশি হয়। এই ধরনের হার্ট সার্জারিতে মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে। তাছাড়া, কম বয়সীদের ক্ষেত্রে বুকের হাড় কেটে সার্জারি করলে তার একটি চিহ্ন থেকে যায়। বাইরে থেকে সার্জারির দাগ বোঝা যায়, যা দেখতে ভাল লাগে না। বয়স্কদের ক্ষেত্রে ব্রেস্টবোন ক্র্যাকিং মানে শরীর আরও কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়া। এই ক্ষত সারতেও সময় লাগে। সেদিক থেকে মিনিমাল ইনভ্যাসিভ সার্জারি অনেক বেশি এগিয়ে।
৬) আপনাদের এখানে ক্যাথ ল্যাব আছে, সেখানে নতুন কী কী হচ্ছে
নারায়ণ মেমোরিয়াল হসপিটালে খুব ভাল ক্যাথল্যাব আছে। নিয়মিতভাবে অ্যাঞ্জিগ্রাফি, অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি, কার্ডিয়াক ইন্টারভেনশন, নিউরো ইন্টারভেশন করা হচ্ছে। এখন টাভি (Cardiac surgery) পদ্ধতিরও প্রয়োগ হচ্ছে।
স্ট্রাকচারাল হার্ট ডিজিজের নতুন দিক হল ‘ট্রান্সক্যাথিটার অ্যাওর্টিক ভালভ রিপ্লেসমেন্ট’ (TAVR) যাকে ‘ট্রান্সক্যাথিটার অ্যাওর্টিক ভালভ ইমপ্ল্যান্টেশন’ বা টাভি (TAVI)বলে। এটা হল মূলত মিনিমাল ইনভ্যাসিভ সার্জারি যেখানে বুকের হাড় কাটার দরকার পড়ে না। পায়ে ছোট ছিদ্র বা ইনশিসন করে সেখান দিয়েই ভালভে অপারেশন করা হয়। অ্যাওর্টিক ভালভ স্টেনোসিসে আক্রান্ত হলে এই ধরনের অস্ত্রোপচার করা হয়। এখানে ক্যাথ ল্যাবে এই পদ্ধতিতেও সার্জারি করা হচ্ছে।
আসল কথা হল, কার্ডিয়াক সার্জারি এখন আর আতঙ্কের কারণ নয়। যদি হার্টে অস্ত্রোপচার করানোর দরকার পড়ে তাহলে ভয় পাবেন না। এখন কার্ডিয়াক সার্জারি এখন অনেক নিরাপদ।