
হার্টের সমস্যা বয়সকালের হলেও তার সমাধান লুকিয়ে ছোটবেলাতেই: ডক্টর পি.সি. মণ্ডল
ডক্টর পি.সি. মণ্ডল
(বিভাগীয় প্রধান, অ্যাপোলো হার্ট ইনস্টিটিউট)
লাইফস্টাইল মডিফিকেশন। আধুনিক সময়ের চিকিৎসা শাস্ত্রের সঙ্গে যেন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গেছে এই শব্দবন্ধ। সভ্যতা যত আধুনিক হচ্ছে, ব্যস্ততা যত বাড়ছে, ততই যেন বদলে যাচ্ছে জীবনযাপনের ধরন। আর তা মোটেই সুবিধের হচ্ছে না শরীরের জন্য। হার্টের অসুখও (Heart Disease) তার ব্যতিক্রম নয়। এখনকার দিনের বড় সমস্যা, দ্রুত হার্টের ক্ষয়, যাকে বলে এজিং, তা রুখতে তাই ভরসা সেই লাইফস্টাইল ম্যানেজমেন্টই। আর সেই ম্যানেজমেন্ট শুরু করার জন্য যদি আপনি অপেক্ষা করেন সমস্যা দেখা দেওয়ার জন্য, তবে তা সামাল দেওয়া কঠিন। তাই হার্টের যত্ন নেওয়ার শুরু হয়ে যাক টিন এজ থেকেই। এই নিয়েই বিস্তারিত আলোচনায় দ্য ওয়ালের প্রতিনিধি তিয়াষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে অ্যাপোলো গ্লেনেগলস হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক প্রকাশ চন্দ্র মণ্ডল।
এ অসুখ আমাদের ‘অর্জন’
ইদানীং যে সমস্ত কার্ডিয়াক প্রবলেম বাড়ছে, সে সবই ‘অ্যাকুয়ার্ড নন-কমিউনিকেবেল ডিজিজ’। কারণ মানুষ যখন জন্মায়, তখন ঘটে যাওয়া কোনও জন্মগত হার্টের ত্রুটি (Heart Disease) ছাড়া, বড় হয়ে বা বুড়ো হয়ে হার্টের যে সমস্ত অসুখ হয়, সেগুলো সবই আসলে পরে ‘অর্জন’ করা। সে হাইপারটেনশন হোক, ডায়াবেটিস হোক বা আর্টারিতে ফ্যাট জমার সমস্যা —যেগুলো থেকে হার্টের সমস্যা বাড়ে ও অসুখে পরিণত হয়, সে সবই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শরীরে তৈরি হয়। এই পুরো বিষয়টাকে একত্রে বলা যায়, অ্যাকুয়ার্ড নন-কমিউনিকেবেল ডিজিজ, যার প্রথমতম ও প্রধানতম একটি কারণ হল লাইফস্টাইল।
তবে হ্যাঁ, পারিবারিক কারণ অবশ্যই একটা বিষয়। কারও পূর্বপুরুষদের ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, আর্টারি ব্লকেজ– এসব থাকলে পরের প্রজন্মের প্রতিনিধিরও তা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু সেটাও যদি বাদ দেওয়া যায়, তবে ইদানীং কালের হার্টের এজিং দ্রুত হওয়ার পেছনে একটাই কারণ জ্বলজ্বল করে, তা হল অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন।
এশিয়ান মানুষদের বিপদ বেশি
বিপদের এখানেই শেষ নয়। পরিসংখ্যান বলছে, এই সমস্ত অ্যাকুয়ার্ড নন-কমিউনিকেবেল ডিজিজ এশিয়ান কান্ট্রিগুলোয় অনেক তাড়াতাড়ি হচ্ছে। অনেক দ্রুত এজিং হচ্ছে হার্টের (Heart Disease)। কখনও চল্লিশ বছরে পৌঁছে, কখনও আবার ৩০ বছর বয়সেও দেখা দিচ্ছে হার্টের সমস্যা।
এশিয়ান মানুষদের এই বিপদের একটা বড় কারণ হল, ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক নিয়মমতেই এই মানুষদের লিপিড প্রোফাইল বলছে, তাদের শরীরে ইনসুলিনের কার্যকারিতা কম। এর ফলে তাদের রক্তে কোলেস্টেরলের যে বিন্যাস, তাতে দেখা যায় ট্রাইগ্লিসারাইড এবং খারাপ তথা ক্ষতিকর উপাদান, ‘এলডিএল’ বেশি। আবার যেগুলোকে বলে প্রোটেক্টিভ বা ভাল কোলেস্টেরল, তার পরিমাণও বেশ কম। এই খারাপ কোলেস্টেরলের অক্সিডাইজ়ড অংশটার মাত্রা আবার খুবই বেশি। একে চিকিৎসা পরিভাষায় বলে ‘আগলি’ কোলেস্টেরল। এই যে আগলি কোলেস্টেরল এবং ভাল কোলেস্টেরল দুটোই একত্রে লিপিড প্রোফাইল তৈরি করে। ফলে আমাদের অর্থাৎ এশিয়ান মানুষদের সাগ্রিক লিপিড প্রোফাইল যে শুধু খারাপ তাই নয়, বরং খারাপতম।
এই খারাপ লিপিড প্রোফাইলের কারণেই এশিয়ান মানুষদের করোনারী সমস্যা অর্থাৎ হার্টের অসুখ অনেক আগে হয়। তার উপরে আমাদের রক্ত অনেক বেশি থ্রম্বোজেনিক। অর্থাৎ সহজে জমাট বেঁধে যায় রক্ত। এর ফলে আচমকা হার্টের সমস্যা এমনকি মৃত্যুও ঘটে থাকে। অনেক সময়ে দেখা যায়, ৩০-৩৫ বছরের ছেলের হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেল। ফলে একদিকে যেমন আমাদের হার্টের অসুখের প্রবণতা স্বভাবগত ভাবে বেশি, তেমনি আবার আচমকা এমার্জেন্সি পরিস্থিতির সংখ্যাও অনেক বেশি।
১২ থেকে ২০ বছর বয়সই আগামীর হার্ট তৈরি করে
এখন এইগুলো যদি আমাদের আটকাতে হয়, হার্টের আয়ু বাড়াতে হয়, বেশি বয়স পর্যন্ত হার্টকে সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম রাখতে হয়, তবে তার শুরুয়াৎ করতে হবে টিনএজেই। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। আমি বলব ১২ থেকে ২০ বছর বয়স হল সারা জীবনের জন্য হার্টকে সুস্থ রাখার, বেশিদিন পর্যন্ত হার্টের এজিং কমিয়ে রাখার আদর্শ সময়। এই বয়সের লাইফস্টাইল মডিফিকেশনই সারা জীবনের জন্য হার্টকে তরতাজা রাখার ব্যবস্থা করে।
এই বয়সেই সাধারণত বাবা-মায়ের নিয়ন্ত্রণ থেকে বাচ্চারা বেরোতে শুরু করে। তাদের খাবারদাবারের ধরন বদলায়, ধূমপান শুরু হয়, অ্যালকোহলের নেশাও হয় কখনও কখনও। এই বয়সে একবার অভ্যাস খারাপ হয়ে গেলে তা পরে ছাড়া খুব মুশকিল। পরে কখনও হার্টের মেজর ড্যামেজ (Heart Disease) হয়ে গেলে তবেই হয়তো তা ছাড়া হয়।
নিয়মিত এক্সারসাইজ জরুরি ছোটবেলা থেকেই
এর পাশাপাশি দ্বিতীয় বিষয়টি হল এক্সারসাইজ। এই ১২ থেকে ২০ বছর বয়সের মধ্যে যদি শরীর নিয়মিত এক্সারসাইজের সঙ্গে টিউনড না হয়, তবে সারা জীবনে আর কখনওই তা হবে না। মাঝবয়সি মানুষ হয়তো একটু হাঁটতে পারবেন, সাঁতার কাটতে পারবেন। কিন্তু তার চেয়ে বেশি কিছু করতে গেলে তাঁর হাড়ের সমস্যা হবে, জয়েন্টে ঘর্ষণ হবে, মাসলে পেইন হবে। তিনি কখনওই নিয়মিত এবং পর্যাপ্ত এক্সারসাইজ করে উঠতে পারবে না। তাই হার্টকে যদি সুস্থ রাখতে হয়, তবে এই বয়সে এক্সারসাইজ শুরু করা খুব জরুরি। এই বয়সে এক্সারসাইজের অভ্যেস তৈরি করলে তা মানুষের মাসেলে একটা মেমরি তৈরি করে। জয়েন্টগুলোও সেই এক্সারসাইজের অভিঘাতকে নেওয়ার মতো করে তৈরি হয়। এই প্রস্তুতি টিনএজেই করতে হয়।
এক কথায় বলতে গেলে, হার্টের এজিং নিয়ে কেউ যদি সচেতন হতে চান, তবে তাকে সেই ট্রেনিং ও শিক্ষা টিনএজেই নিতে হবে। তবেই সে হার্টের দিক থেকে তরুণ থাকবে এবং সেটা মেনটেনও করা সম্ভব হবে আজীবন। এসবের পাশাপাশি নিয়মিত বাইরের রোদে খেলাধুলো করতে হবে ছোটদের। তবেই শরীরে ভিটামিন ডি সংশ্লেষ হবে। যা শরীরকে সামগ্রিক ভাবে অনেক পোক্ত রাখবে। এর সুফল পাবে হার্টও।
রঙিন ফল-সব্জি, কম নুন হার্টকেও রাখবে উজ্জ্বল
কোনও রকম নেশা এড়িয়ে চলা এবং নিয়মিত এক্সারসাইজ করার পাশাপাশি যেটা অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তা হল খাদ্যাভ্যাস। এটা পরীক্ষিত সত্য, যে যাদের ছোটবেলা থেকে খাদ্যাভ্যাসে বেশি ফলমূল, শাকসব্জি থাকে, তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ভাল হয়। তাদের হার্টের এজিং অনেক ধীর হয়। প্রাকৃতিক ভাবে রঙিন খাবারে ফ্ল্যাবনয়েডস এবং ক্যারটিনয়েডস নামের ফাইটোকেমিক্যালস। এগুলি অ্যান্টি কার্সিনোজেনিক, অ্যান্টি এজিং, অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট। বিট, গাজর, কমলালেবু, টোম্যাটো—এই ধরনের রঙিন খাবারে ফাইটোকেমিক্যালসের পরিমাণ অনেক বেশি। ফলে সেগুলো টিনএজ থেকেই প্রচুর পরিমাণে খেতে হবে ভবিষ্যতে হার্ট ভাল রাখার স্বার্থে। যাঁরা এই সমস্ত খাবারে অভ্যস্ত, তাঁদের হার্টের এজিং অনেক ডিলেইড।
এই ডায়েটেরই একটা অংশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল নুন খাওয়ার প্রবণতা। লবণ যত বেশি খাওয়া হয়, হার্টের আর্টারি তত দ্রুত তত বেশি পুরু হয়ে যায়, হার্টের ক্ষতিও স্বাভাবিক ভাবেই বাড়ে। তাই ছোটবেলা থেকে ‘লো-সল্ট ডায়েট’ অভ্যাস করা খুব জরুরি। ৬০-৭০ বছর বয়সে হার্টের অসুখ দেখা গেলে হঠাৎ নুন খাওয়ার পরিমাণ কমালে অসুবধা হতে পারে। সোডিয়াম কমে যেতে পারে বা আরও ঘাটতি দেখা দিতে পারে। কিন্তু যাদের বরাবরই অভ্যেস কম নুনের রান্না খাওয়ার, তারা এ সমস্যা এড়াতে পারবে।
এমনিতেই আমাদের রান্নার ধরনটি শরীরের পক্ষে সমস্যাজনক। আমরা বেশিরভাগ রান্নাই ভেজে খাই। এর ফলে খাবারের প্রাকৃতিক পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়ে যায়। যেমন মাছের ক্ষেত্রে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে, যা অ্যান্টি এজিং উপাদান। কিন্তু মাছ ভাজলেই তা আর থাকে না। তাই কম ফ্রাই করা, বেকড জিনিস যত বেশি খাওয়া হবে, তার প্রাকৃতিক পুষ্টিগুণগুলোও তত থাকবে। কারণ কোনও খাবারকে ভাজলেই তার ফ্যাট বদলে যায় ট্রান্স ফ্যাটে, যেটা শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
প্যানডেমিকের উদ্বেগ ক্ষতি করছে হার্টের
এই হার্টের এজিং নিয়ে আলোচনা করার ক্ষেত্রে আরও একটা জিনিস মনে রাখা জরুরি, তা হল স্ট্রেস। কারণ স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টও হল হার্টের এজিং রোখার একটি অস্ত্র। বিশেষ করে এখন এই প্যানডেমিক পরিস্থিতিতে মানুষের স্ট্রেস যত বাড়ছে, এজিং-ও তত দ্রুত হচ্ছে। তাই এই সময়ে প্রতিটি মানুষের আরও বেশি করে খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করা, স্মোকিং না করা অনেক বেশি জরুরি। জরুরি ফাইটোকেমিক্যালসে পরিপূর্ণ খাবার বেশি করে খাওয়া জরুরি। পাশাপাশি স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের আরও একটা উল্লেখযোগ্য উপায় হল, কারও হার্টের কোনও সমস্যা থাকলে বা কোনও সমস্যা অনুভব করলে তিনি ঘরের মধ্যে তা নিয়ে উদ্বেগ না করে ডাক্তারের কাছে গিয়ে কথা বলুন। ডাক্তারের সঙ্গে সমস্যা ভাগ করে নেওযা স্ট্রেস কমানোর একটা দিক।
পাশাপাশি এই সময়ে এক্সারসাইজও খুব জরুরি। কারণ ঘেমেনেয়ে এক্সারসাইজ করলে শরীরের বিভিন্ন উদ্বেগ বাড়ানোর হরমোনগুলো আপনাআপনিই ড্রেইনড হয়ে যায়, ফলে স্ট্রেস লেভেল কমে যায়। প্রাণায়ম বা যোগাভ্যাস করলেও প্রায় একই ফল মিলতে পারে। ফলে এই প্যানডেমিক পরিস্থিতিতে হার্টের ক্ষয় রুখতে ও হার্ট নিয়ে ভয় কমাতে নিয়ম মেনে চলতেই হবে।