
করোনা-কালে অবহেলা, হার্টের বয়স বেড়ে চলেছে দ্রুত: ডক্টর শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
ডক্টর শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
(সিনিয়ার কনসালট্যান্ট ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট, অ্যাপোলো)
মানুষের বয়স বাড়ে, সেই সঙ্গে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেরই বয়স বাড়ে। ব্যতিক্রম নয় হার্টও। কিন্তু হার্টের বয়স দ্রুত বেড়ে গেলে তা সমস্ত শরীরের জন্যই অশনি সংকেত। ঠিক সেটাই ঘটাচ্ছে করোনা মহামারী। করোনা ও লকডাউনের যৌথ সমস্যায় গত কয়েক মাস ধরে অবহেলিত হচ্ছে শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটি। তার বয়স দ্রুত বাড়ছে, এমন কিছু ক্ষতি হচ্ছে, যা আর সারানোর আয়ত্বে থাকছে না অনেক সময়েই। তাই করোনার ঝুঁকি থেকে বাঁচতে হার্টের ঝুঁকি তথা জীবনের ঝুঁকি বাড়ানো কোনও কাজের কথা নয়। এ নিয়েই দ্য ওয়ালের প্রতিনিধি তিয়াষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনায় ডক্টর ও অধ্যাপক শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।
লকডাউন যখন শুরু হল, তখন কেবল আমাদের দেশে নয়, সারা পৃথিবীতে হার্টের অসুখ বেশ কমে গিয়েছিল। এর কারণ নিয়েও ভাবনাচিন্তা করেছেন বিশ্বজোড়া চিকিৎসকরা। একটা কারণ মনে করা হচ্ছিল, হার্ট অ্যাটাক হয়তো হচ্ছে মানুষের আগের মতোই, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁরা ডাক্তার দেখাচ্ছেন না বা হাসপাতালে আসছেন না। হয়তো মারাও যাচ্ছেন, কিন্তু তাঁদের রোগ ধরা পড়ছে না।
তবে এর পাশাপাশি অন্য কারণও ছিল হার্ট অ্যাটাকের সংখ্যা কম হওয়ার। মহামারী পরিস্থিতির জন্য যে গৃহবন্দি অবস্থা, তাতে প্রাত্যহিক স্ট্রেস ও মানসিক দুশ্চিন্তা অনেকটাই কমে গেছিল অনেকের। অফিসের চাপ, পথেঘাটের চাপ কম থাকায় হার্ট অনেকটাই রিল্যাক্সড থাকছিল একটা বড় অংশের মানুষের। এটাও হার্ট অ্যাটাক কমার একটা কারণ বলে মনে করা হয় প্রথমে। তৃতীয় যে কারণটি সামনে আসে, সামগ্রিক ভাবে দূষণ কমে যাওয়ায় হার্টের স্বাস্থ্য অনেক ভাল থাকছিল লকডাউনের প্রথম দিকে। বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণ হার্টের বড় শত্রু। এই দুটোই অনেকটা কমে যাওয়ার ফলে হার্টের সমস্যাও কমেছে গোড়ায়।
এর সঙ্গে চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে মনে করা হয়েছিল, মানুষের খাদ্যাভ্যাস অনেক ভাল হয়েছে। বাইরের খাবার খাওয়া কমেছে, ঘরের খাবার খাওয়া বেড়েছে। অনেকে পর্যাপ্ত সময় ঘুমিয়েছেন, এক্সারসাইজ করছেন।লাইফস্টাইল অনেক বেটার হচ্ছে।
লকডাউনের কয়েক মাসের পর থেকে বাড়ছে হৃদরোগ
এই সব ক’টা কারণ মিলিয়ে মহামারীকালে হার্টের অসুখ কম হওয়ার বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছিলেন চিকিৎসকরা। তবে এমনটা স্থায়ী হলে খুবই ভাল হতো। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হল, হার্টের এই সুস্থতার ধারণা গোড়ার কয়েক মাস পরে এখন বদলে গিয়েছে। এখন যত এগোচ্ছে প্যানডেমিক পরিস্থিতি, তাতে দেখা যাচ্ছে, অনেক বেশি সংখ্যায় হার্ট অ্যাটাকের ঘটনা বেড়ে চলেছে। আমরা অনেক বেশি রিপোর্ট পাচ্ছি গত দুয়েক মাসে। এর কারণ কী হতে পারে, তারও কিছু ব্যাখ্যা রয়েছে।
একটানা লকডাউনের পরে মানুষ যখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে, দীর্ঘ বিশ্রামের পরে ফের দৌড়ঝাঁপ শুরু হচ্ছে, তার আচমকা অভিঘাত ক্ষতি করছে অনেকের। দ্বিতীয় ও অন্যতম একটা সমস্যা হল, এই লকডাউনে অনেকে অনেক রকম ছোটখাটো শারীরিক সমস্যা নিয়েই বাড়িতে থেকেছেন গৃহবন্দি থাকার স্বার্থে। ডাক্তার দেখাননি। হয়তো বুকে স্বল্প ব্যথা হয়েছে, সেটুকু নিয়ে তিনি আর হাসপাতালে বা ডাক্তারখানায় যাননি। সুগার, প্রেশার, কোলেস্টেরল—এসবও হয়তো নিয়মিত পরীক্ষা করেননি অনেকে। নিঃশব্দে ক্ষতি বেড়েছে শরীরে। এবার অবহেলার ফল পাচ্ছে তাঁদের হার্ট, ফল পাচ্ছেন তাঁরাও।
বয়স বাড়ছে হার্টের
আমাদের কাছে এখন হার্টের সমস্যা নিয়ে এমন অনেক রোগী আসছেন, যাঁদের পরীক্ষা করে আমরা দেখতে পাচ্ছি, বেশ অনেকটা ক্ষতি হয়ে গেছে হার্টের। সমস্যা অ্যাডভান্সড স্টেজে পৌঁছে গেছে। প্রশ্ন করলে জানতে পারছি, সামান্য সমস্যা অনুভব করেও গত কয়েক মাস ধরে সেটি এড়িয়ে গিয়েছেন তাঁরা। করোনা থেকে বাঁচতে গিয়ে হার্টের ছোট সমস্যাকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। ফলে তা চিকিৎসার জন্য বেশ কঠিন হয়ে যাচ্ছে এখন আমাদের কাছে। হার্টের এজিং-ও এর ফলে দ্রুত হয়ে যাচ্ছে।
আমাদের শরীরের ও শরীরের অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের যেমন বয়স বাড়ে, তেমনি আমাদের হার্টেরও বয়স বাড়ে। যেমন বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হার্টের পেশিগুলো পুরু হয়ে যায়। হার্টের ভেতরে রক্তের চাপ বাড়ে। আর্টারির গায়ে চর্বি জমে মোটা হয়ে যায়। এগুলো কম-বেশি সকলেরই হয়। কিন্তু এর সঙ্গে যদি কারও ব্লাডপ্রেশার, কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিস এসব থাকে, সেই সঙ্গে কায়িক শ্রম যদি কম হয়, ওবেসিটি যদি বাসা বাঁধে, তাহলে হার্টের এই এজিং অর্থাৎ হার্টের বুড়িয়ে যাওয়া আরও দ্রুত ঘটে। প্রসঙ্গত, একটা নির্দিষ্ট ক্যালকুলেটর রয়েছে। সেখানে কারও বয়সের সঙ্গে রিস্ক ফ্যাক্টরগুলি নিয়ে হিসেব করলে দেখা যায়, হার্টের বয়স তাঁর বয়সের চেয়ে কতটা বেশি হচ্ছে বা কত হচ্ছে। হয়তো মানুষটির বয়স ৫০, কিন্তু তাঁর হার্টের বয়স বেরোয় ৭০ বা ৮০। তুলনামূলক ভাবে রোগবিহীন কোনও ৫০ বছরের মানুষের ক্ষেত্রে হয়তো দেখা যাবে, হার্টের বয়সও ৫০-ই। অর্থাৎ তাঁর হার্ট সঠিক মাত্রায় কার্যকর রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথম জন ৫০ বছর বয়সি হয়েও, ৭০ বা ৮০ বছরের মতো একটি হার্ট নিয়ে বেঁচে আছেন।
হার্টের সঙ্গে আপস নয়, মহামারী কোনও অজুহাত নয়
এখন অসুখ ফেলে রাখলে, চিকিৎসা না করালে হার্টের এই এজিংটা দ্রুত হয়ে যাচ্ছে। প্যানডেমিক পরিস্থিতি সেটাই ঘটাচ্ছে। তার উপরে মানুষের মনের ভিতরে রয়েছে সংক্রমণের উদ্বেগ। যেটার ফলে তাৎক্ষণিক ভাবে কিছু না ঘটলেও, তা দীর্ঘকালীন সমস্যা তৈরি করবে।
এই বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষের উদ্দেশে আমার একটি বিশেষ বার্তা দেওয়ার আছে। কারও যদি বুকে কোনও রকম সমস্যা হয়, বা অন্য কোনও সমস্যাও— সেক্ষেত্রে ডাক্তার কিন্তু দেখাবেন। সঠিক সময়ে না দেখালে আচমকা কোনও বড় সমস্যায় পড়তে পারেন। আর কয়েক মাস এভাবে চালিয়ে দিতে পারলেও, পরে যখন ডাক্তার দেখাবেন, তখন দেখা যাবে বিষয়টা হয়তো অনেক বেড়ে গেছে। অ্যাডভান্সড স্টেজে একটা অসুখের চিকিৎসা যতটা কঠিন, গোড়ায় ধরা পড়লে হয়তো তা নিয়ন্ত্রণ করা ও সারানো আরও অনেকটা সহজ। বিশেষ করে সমস্যা যখন হার্টে, তা সবসময় পর্যাপ্ত গুরুত্ব দাবি করে। মহামারী হোক বা না হোক, তার সঙ্গে আপস করা যাবে না।
বাজারের চেয়ে হাসপাতালের ঝুঁকি অনেক কম
কেউ যদি ভাবেন, হাসপাতালে গেলে বা চিকিৎসকের কাছে গেলে করোনার ঝুঁকি রয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি ঝুঁকি রয়েছে হার্টের সমস্যা নিয়ে বাড়িতে বসে থাকলে। কেউ যদি মাস্ক পরেন, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলেন এবং স্যানিটাইজ় করেন নিজেকে, তাহলে তিনি হাসপাতালেই আসুন আর বাজারেই যান, তাঁর করোনা এড়ানোর সম্ভাবনা থাকবে সর্বত্রই। অর্থাৎ যিনি আজ বাজার যাচ্ছেন বা বাসে চাপছেন, তিনি হাসপাতালে গেলে যে বেশি সমস্যায় পড়বেন করোনা নিয়ে, তা কখনওই নয়। করোনা হওয়া সত্ত্বেও কেউ ঘুরে বেড়ায় না রোগ ছড়ানোর জন্য। কিন্তু যাঁদের করোনা আছে কিন্তু উপসর্গ নেই, তাঁরাই আসলে ভয়ের কারণ। ফলে হাসপাতালে আসা আলাদা করে ঝুঁকির বিষয় হতে পারে না কখনওই।
বরং আমি বলব, হাসপাতালের সাবধানতা অনেক বেশি। সেখানে নিয়মিত স্যানিটাইজেশন হয়, সামাজিক দূরত্ব মানার চেষ্টা হয়। চিকিৎসকরাও ব্যবস্থা নিয়েই রোগী দেখেন। দোকানদার যতটা সাবধানতা নিয়ে ব্যবসা করেন, তার চেয়েও অনেকটা বেশিই সাবধানতা নেওয়া হয়। ফলে হাসপাতালে বা ডাক্তারখানায় যাওয়ার ভয়ে ডাক্তার না দেখানোর যুক্তিটা গ্রহণযোগ্য নয়। এটা মানুষকে বুঝতে হবে।
এই প্রসঙ্গে মনে করাই, কোভিডের মৃত্যু হার ২.৫ শতাংশ, কিন্তু হার্ট অ্যাটাক হলে তার মৃত্যুহার ১২ শতাংশ। ভয় দেখানো আমার উদ্দেশ্য নয়, সতর্কতা বাড়ানোর বার্তা দেওয়াটাই উদ্দেশ্য।
নিয়ম মেনেই হার্টের যত্ন
মাস্ক, স্যানিটাইজার, দূরত্ব—এই তিনটের দিকে জোর দেওয়া বেশি জরুরি, কোনও জরুরি জায়গায় যাওয়া বা না যাওয়ার থেকে। কারণ কারও যদি বুকে কষ্ট হয়, তাই নিয়ে চিকিৎসককে তিনি না দেখান, সহ্য করেন, তাহলে কিন্তু যে কোনও সময় এমার্জেন্সি সিচুয়েশন তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। শুধু তাই নয়, পরে যখন তাঁরা আমাদের কাছে আসছেন, আমরা দেখছি সঙ্গে সঙ্গে এলে হয়তো অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করে যে জায়গায় হার্টকে ফেরানো যেতে পারত, এখন আর তা সম্ভব হচ্ছে না। চিরকালের একটা ড্যামেজ রয়ে গেল। বাড়িতে বসে গোল্ডেন আওয়ার পার করে ফেলার ঝুঁকি দুটো। এক, বাড়িতেই হৃদরোগে বাড়াবাড়ি বা মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে আর দুই, সারাজীবনের মতো স্থায়ী ক্ষতি হয়ে যেতে পারে হার্টে।
একথা নিশ্চিত ভাবে বলা যা, হার্টের সমস্যার মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় করোনার ভয়ে বাড়িতে বসে লুকিয়ে রাখা বা সহ্য করার যে ঝুঁকি, তা করোনা সংক্রমণের ঝুঁকির চাইতে একটুও কম নয়। বরং কয়েক গুণ বেশি। ফলে সাবধানে থাকুন, হার্টের যত্ন নিন। মহামারী হোক বা না হোক।