করোনা কালে সুস্থ থাক কিডনি, শরীরের ছাঁকনিকে ভাল রাখার উপায় কী

দ্য ওয়াল ব্যুরো: করোনার সংক্রমণ শুধু ফুসফুসকে নয়, কাবু করছে কিডনিকেও। হার্ট ফেলিওর, লিভারের রোগ, খাদ্যনালীর সংক্রমণ, রক্তনালীতে জমাট বাঁধছে রক্ত। শরীরের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে জটিল রোগ ধরছে। আর সব কিছুরই ফল ভোগ করছে শরীরের ছাঁকনি। তবে শুধু করোনাভাইরাস বলে নয়, কিডনিকে সুস্থ ও তরতাজা না রাখতে পারলে শরীরও তার প্রতিবাদ করে। রক্তের দূষিত পদার্থ ছেঁকে বের করা শুধু নয়, শরীরে জল ও লবনের ভারসাম্যও বজায় রাখে কিডনি। তাই এই অঙ্গটিকে হেলাফেলা করা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

দেখতে ছোট, কিন্তু কাজে মহান। শরীরের এই দু’টি অঙ্গ যদি কাজে ইস্তফা দেয়, তাহলে শত সাধ্যসাধনাতেও জীবনের গাড়ি আর সরসরিয়ে চলবে না। কথায় বলে মানুষ দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বোঝে না। কিডনির ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা অনেকটা সেরকমই। সারা শরীরের জঞ্জাল সাফাইয়ের দায়িত্ব অনেকটাই তার ঘাড়ে। দূষিত রেচন পদার্থ যদি শরীর থেকে বেরিয়ে না যায়, তা হলে তা জমা হয় ভেতরেই। আর একে একে আঘাত করতে থাকে শরীরের বাকি অঙ্গগুলিকে। তাই কিডনিকে সুখে রাখতে কী কী করণীয় সেটা জেনে নিতে হবে আগে।

কিডনি হল শরীরের ছাঁকনি। যার কাজ খারাপগুলোকে ছেঁকে বাইরে বার করে দেওয়া। অনেকটা ফিল্টারের মতো কাজই করে কিডনি। তাকে সুস্থ-তরতাজা রাখতে গেলে আগে জেনে নিতে হবে কিডনির ভূমিকা ঠিক কতটা এবং এর কলকব্জা বিগড়ে গেলে ক্ষতি কতটা হতে পারে।

চনমনে কিডনি, শরীরের নোংরা সাফ করে

কিডনি শুধু শরীর থেকে রেচন পদার্থই বার করে না, তার ভূমিকা আরও বেশি। যেমন–রক্তে সোডিয়াম, পটাশিয়ামের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে কিডনি। অ্যাসিডোসিস হয়ে রক্তে অ্যাসিডের মাত্রা যাতে লাগামছাড়া না হয়ে যায় সেদিকেও তার কড়া নজর। হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক রাখতেও এর ভূমিকা আছে। তা ছাড়া, শরীরে জলের ভারসাম্য বজায় রাখা, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, রক্তকণিকা উৎপাদনে সাহায্য করা, হাড়ের স্বাস্থ্য ভাল রাখা, কিডনির দায়িত্ব অনেক।

রোগ ধরছে না তো! বুঝবেন কী করে

কিডনির সমস্যা একটা নয়, বরং একাধিক। ক্রনিক ডিজিজ থেকে এর রোগ প্রাণঘাতীও হতে পারে। গ্লোমেরিউলোনফ্রাইটিস, পলিসিস্টিক ডিজিজ, ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন—কিডনি নানা সমস্যায় জেরবার হতে পারে। নেফ্রোলজিস্টরা বলেন, কিডনির রোগ অনেকসময়েই জানান দিয়ে আসে না। চুপিসারে বাসা বাঁধে, একদিন আচমকাই বিস্ফোরণের মতো ছড়িয়ে পড়ে। তবে কিছু উপসর্গ দেখে সচেতন হওয়াই যায়। যেমন–কারও উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার সমস্যা থাকলে তার প্রভাব পড়ে কিডনিতেও। সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। হঠাৎ করে জাঁকিয়ে বসা অবসাদ, ঘুম ঘুম ভাব, মনঃসংযোগের সমস্যা, খিদে নষ্ট, অল্প পা ফোলা, শরীরে রক্ত কমে যাওয়া এইসব রোগের আগমন হলে আগেভাগেই সতর্ক হওয়া উচিত।

নেফ্রোলজিস্টরা বলেন, কিডনির সমস্যা হলে সবচেয়ে আগে প্রভাব পড়ে মূত্রে। কোমরে বা তলপেটে ব্যথা, মূত্রে জ্বালা, রঙের বদল হলে চিকিৎসকের দ্বারস্থ হওয়া উচিত। প্রায়ই যদি মূত্রথলি ও প্রস্রাবে সংক্রমণ হয় তাহলেও ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া দরকার।

কিডনিতে করোনা!

করোনা সেখানেই সংক্রমণ ছড়াবে যেখানে সে তার রিসেপটর বাইন্ডিং ডোমেন পাবে। অর্থাৎ যে অঙ্গের কোষে ভাইরাস তার বন্ধু প্রোটিন পাবে। কোষের রিসেপটর তথা অ্যাঞ্জিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম-২ (ACE-2) ভাইরাল প্রোটিনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন। এই রিসেপটর কিডনির কোষে বেশি আছে। তাই ভাইরাস সেখানে দ্রুত প্রতিলিপি তৈরি করে ছড়িয়ে পড়তে পারছে। তাছাড়া করোনার সংক্রমণে সাইটোকাইন প্রোটিনের বেশি ক্ষরণে ইনফ্ল্যামেশন বা প্রদাহজনিত রোগ বেশি হচ্ছে। যার প্রভাবও পড়ছে শরীরের নানা অঙ্গে।

কিডনিতে সংক্রমণ ধরেছে কিনা তা বোঝা খুব মুশকিল। ডাক্তারবাবুরা বলছেন, কোভিডের জটিল পর্যায়ে শরীরে রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা খুব বেড়ে যায় বলে সবচেয়ে ক্ষতি হয় কিডনির। বহু রোগীকেই তখন ডায়ালিসিস করতে হয়। অর্থাৎ যন্ত্রের সাহায্যে রক্ত ছেঁকে পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করতে হয়। সেরে ওঠার পরেও কিডনি তার স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু করতে পারে অন্তত তিন থেকে চার সপ্তাহ পরে।

তাই করোনা কালে প্রয়োজনের থেকে বেশি সচেতন থাকতে হবে। নিয়মিত চেক-আপ করাতে হবে। বেশি ঠান্ডা লাগানো উচিত হবে না। এসি ঘরে থাকার বদলে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় থাকুন। কিডনির রোগ আছে যাঁদের, তাঁরা সময়মতো ডায়ালিসিস করতে থাকুন।

আতঙ্ক রেনাল-স্টোন

কিডনিতে পাথর জমেছে মানেই আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা শুরু হয়ে যায়। নেফ্রোলজিস্টরা বলেন নিয়মিত চেক-আপ এবং কিছু উপসর্গ দেখে আগেভাগেই সতর্ক হওয়া যায়। পাথরের আকার যদি ছোট হয় তাহলে অনেক সময়েই লক্ষণ বোঝা যায় না। সংখ্যায় বাড়লে কিছু উপসর্গ প্রকাশ পায়। যেমন:

  • কিডনিতে পাথর বা স্টোন জমলে মূত্রের রঙ বদলে যাবে। লালচে বা ঘন বাদামি রঙ হবে।
  • কোমর ও তলেপেট ব্যথা হবে। প্রস্রাবের সময় জ্বালা করবে। দীর্ঘসময় কোমরে চিনচিনে ব্যথা থাকবে।
  • সারাদিন ঝিমুনিভাব থাকবে। বমি ভাব দেখা যাবে। কিছু খেলে হজমে সমস্যা হবে।
  • ঘুরেফিরে জ্বর আসতে পারে। শরীরের তাপমাত্রা ওঠানামা করবে।

সুস্থ ছাঁকনির সাতকাহন

জল খান, তবে মেপে। অনেকেরই ভ্রান্ত ধারণা আছে বেশি জল খেলে কিডনি বেশি ভাল থাকবে। নেফ্রোলজিস্টরা বলেন, সুস্থ মানুষ অতিরিক্ত জল খেলে তাঁর রক্তে সোডিয়ামের মাত্রা কমে যেতে পারে। যাকে বলা হয় হাইপোনেট্রিমিয়া। তাতে অনেক সময়ে মস্তিষ্ক বিকৃতির মতো গুরুতর লক্ষণও দেখা যেতে পারে। জল খেতে হবে নিয়ম করে, তবে মাত্রাতিরিক্ত নয়। দিনে ৬ গ্লাসের বেশি জল খাওয়াটা কিডনির জন্য খুব একটা সুখের নয়। তবে শারীরিক অবস্থা বিচার করেই এর সঠিক মাপকাঠি বলে দেন ডাক্তাররা।

গুডবাই জাঙ্ক ফুড। রক্তচাপের ভারসাম্য বিগড়ে গেলে, ডায়াবেটিস বা কার্ডিওভাসকুলার রোগ থেকে কিডনির অসুখ হতে পারে। তাই সে ক্ষেত্রে খাবারের তালিকায় একটু বিশেষ নজর দিতে হবে বইকি। পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে, ভাজাভুজি, ঝাল-তেল-মশলা যতটা কম খাওয়া যায় ততটাই ভাল। আবার ওজন কমানোর নেশায় কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার বন্ধ করে দিলেও মুশকিল, বরং কিছুটা কমিয়ে খান। জাঙ্ক ফুড খেতে মন চাইলে সপ্তাহে এক-আধ দিন, তার বেশি হলেই বিপদ।

ওজন থাক বশে। যত বেশি ওজন, তত কিডনির ক্ষতি। নিয়মিত শরীরচর্চা অবশ্যই দরকার। পুষ্টিকর খাবার, সেই সঙ্গে ব্যায়ামের বিকল্প নেই। তবে নেফ্রোলজিস্টরা বলেন, চটজলদি রোগা হওয়ার জন্য অতিরিক্ত ব্যায়াম বা বাজারচলতি ডায়েট চার্ট মেনে চললে বিপদ আরও বাড়তে পারে। নির্দিষ্ট সময়ের বেশি এবং বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া কোমর বা পায়ের ব্যায়াম বা ওয়েট ট্রেনিং করলে কিডনির সমস্যা হতে পারে।

ভিটামিন বা সাপ্লিমেন্ট বেশি নয়। অনেককেই দেখা যায় সামান্য দুর্বলতাতেই মুঠো মুঠো ভিটামিন খেতে শুরু করেন। অথবা কোনও আয়ুর্বেদিক সাপ্লিমেন্ট। যে কোনও ওষুধ খাওয়ার আগেই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। অতিরিক্ত ভিটামিন ট্যাবলেট বা কোনও রকমের সাপ্লিমেন্ট, স্টেরয়ডাল অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটরি গ্রুপের ব্যথার ওষুধ, কিছু অ্যান্টিবায়োটিক, মৃগি বা টিবির ওষুধ, স্টেরয়েড ইত্যাদি কিডনির রোগের জন্ম দেয়।

মদ, সিগারেট দূরে থাক। অ্যাম্ফিটামিন, হেরোইন, কোকেন, গাঁজা, ভাং, এমনকী দীর্ঘ দিন ধরে প্রচুর মদ খেলেও বিপদ হতে পারে৷ আবার দেশি মদে, যেখানে মিথাইল অ্যালকোহল ভেজাল মেশানো হয়, তা খেলে সঙ্গে সঙ্গে কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে। সিগারেট যে ক্ষতির কারণ সেটা আর আলাদা করে বলার কিছু নেই। অধিক ধূমপান মানেই কিডনির দফারফা। অতএব সিগারেট-মদ-মাদক থেকে যতটা দূরে থাকা যায় ততটাই ভাল।

খাওয়ার নিয়ম। খাবারের মোট ক্যালোরির ৬০–৬৫ শতাংশ যেন কার্বোহাইড্রেট থেকে আসে৷ এখন যতটা নুন খান তার চেয়ে ২ গ্রাম কম খান৷ দিনে এক চা–চামচের বেশি নয়৷ খাবার বানান কম নুনে৷ বয়স ৪০ বছরের কাছাকাছি হলে, ওজনের ১০ শতাংশের বেশি প্রোটিন খাওয়া ঠিক নয়৷ অর্থাৎ ওজন ৬০ কিলোগ্রাম হলে প্রোটিন খেতে হবে ৬০ গ্রামের মতো৷
নিয়মিত চেকআপ জরুরি—ডায়াবেটিসের রোগী হলে নিয়মিত চেকআপ জরুরি। প্রস্রাবের সমস্যা, বা সংক্রমণজনিত সমস্যা থাকলেও ডাক্তারের পরামর্শ মতো ওষুধ খাওয়া দরকার। কিডনির যত্ন নিতে প্রতি তিন মাস অন্তর সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে কিছু রুটিন পরীক্ষা করানো দরকার।