
লিভার সিরোসিস জব্দ হবে, ভিলেন প্রোটিনদের শায়েস্তা করতে নতুন খোঁজ বিজ্ঞানীদের
চৈতালী চক্রবর্তী
কী থেকে লিভার খারাপ হয়? কেউ বলবেন অতিরিক্ত মশলাদার খাবার, কারোর মতে অনিয়মিত জীবনযাপন, লাগামছাড়া অ্যালকোহল। যুক্তি-পাল্টা যুক্তিও রয়েছে বিস্তর। গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্টরা বলেন লিভার নিয়ে মানুষের মনে দীর্ঘস্থায়ী ভুল ধারণা আছে। অনেকে মনে করেন অ্যাসিডিটিন ডায়ারিয়া বা বদহজম মানেই লিভারের অসুখ। সেটা নয় একদমই। লিভারের জটিল রোগ বা সিরোসিস (Liver Cirrhosis )-কারণ অনেক এবং এর প্রভাবও প্রাণদায়ী। জ্বালাপোড়া লিভার থেকে মুক্তির পথ মানেই গাদা গাদা অ্যান্টিবায়োটিক যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মারাত্মক।
বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণা ছিল এই লিভার সিরোসিসকে কীভাবে সমূলে বিনষ্ট করা যায়। অথবা সিরোসিস ঘাঁটি তৈরি করলেও তার প্রভাবকে বিপরীতমুখী করে তোলা যায়। ধরা যাক, দিনের পর দিন অ্যালকোহলে আসক্ত হয়ে পড়েছেন কেউ। ধীরে ধীরে লিভারের কোষ পচে-গলে জটিল রোগ দেখা দিল। এখন নতুন আবিষ্কার হবে এমন যে হয় আগে থেকেই লিভারকে বর্ম পরিয়ে নিরাপদ করে রাখা হবে, অথবা সেই ক্ষত ভরিয়ে দেওয়া হবে বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়ায়। সেই গবেষণাতেই আশার আলো খুঁজে পেয়েছেন আমেরিকার মেডিক্যাল সেন্টার ‘মেয়ো ক্লিনিক’-এর বিজ্ঞানীরা। গবেষকরা বলছেন, লিভারের রোগের মূল ভিলেন দুটি প্রোটিনের কারসাজি যদি বন্ধ করে দেওয়া যা, তাহলেই কেল্লাফতে। হেপাটাইটিস, ফ্যাটি লিভারের মতো জাঁদরেল রোগের হাত থেকেও মুক্তি মিলবে।
সিরোসিস (Liver Cirrhosis) কুরে কুরে খায় লিভারের কোষকে, প্রভাব প্রাণঘাতী
গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্টরা বলেন লিভারের ফাইব্রোসিস (fibrosis) বা দগদগে ক্ষতের ফাইনাল স্টেজ হল সিরোসিস (Advanced Cirrhosis )। লিভারের কাজকর্মে ইতি তো টানেই, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খাড় করে দেয় যাবতীয় কোষ-কলাকে। সিরোসিস যদি ক্রনিক হয়ে যায়, তাহলে বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ। লিভার ক্যানসারকে নিমন্ত্রণ করে ডেকে আনে। অতিরিক্ত মদ্যপান, হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, ফ্যাটি লিভার, সিস্টিক ফাইব্রোসিস (cystic fibrosis), পিত্তথলির সমস্যা (biliary atresia) যখন জাঁকিয়ে বসে তর্জন-গর্জন শুরু করে, তখন তাকেই সিরোসিস বলে।
চিকিৎসকরা বলেন, অতিরিক্ত তেলমশলাদার খাবার, অ্যালকোহল থেকে চড়চড়িয়ে বাড়ে কোলেস্টেরল। ট্রাইগ্লিসারাইড ও ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের সমস্যা দেখা দেয় যাকে বলে ‘মেটাবলিক সিনড্রোম’ বলে। এই সিনড্রোম একটু একটু করে সিরোসিসের জন্ম দেয়।
জন্মগত কোনও ত্রুটি ও কিছু কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য লিভারের অসুখ হতে পারে। মদ্যপানে রাশ টানতে এবং পেটের ব্যথা কমাতে অনেকে নানারকম ওষুধ খেয়ে থাকেন। এই সব ওষুধ সাময়িক ভাবে যন্ত্রণা কমালেও, পাকাপাকিভাবে লিভারের কার্যক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। বাসা বাঁধে অসুখ।
ভাইরাল হেপাটাইটিস লিভার সিরোসিসের আরও একটা কারণ। হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি, ই ইত্যাদি ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটায় লিভারে। জ্বালাপোড়ার মত যন্ত্রণা হয়। লিভার ফুলে যায়। এর ভিতরের কোষে সিস্ট জমা হতে শুরু করে। দেখা দেয় ফাইব্রোসিস। এরই ফাইনাল স্টেজ হল সিরোসিস। অনেক সময় এর থেকে হেপাটোসেলুলার কার্সিনোমা বা লিভারে ক্যানসারও দেখা দেয়।

লিভারের ভিলেন দুই প্রোটিন—YAP এবং TAZ
মেয়ো ক্লিনিকের বিজ্ঞানীরা বলছেন, লিভারের যে কোনও অসুখে বা সিরোসিসে এই দুই প্রোটিনের ক্ষরণ সবচেয়ে বেশি হয়। এরাই লম্ফঝম্প করে লিভারের ভিতরের কোষগুলির ধ্বংসলীলায় মেতে ওঠে। Scar Tissue বা ক্ষতিগ্রস্থ কোষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ভালো কোষগুলিকে যেচে খারাপ করে এরাই। কাজেই এই দুটি প্রোটিনকে যদি কব্জা করে ফেলা যায়, তাহলেই সংক্রমণ রোখা যাবে। আর সংক্রামিত কোষগুলিকে ছেঁটে ফেললেই বাকি কোষগুলিকে বাঁচানো সম্ভব হবে। রক্ষা পাবে লিভার।
গবেষকরা বলছেন YAP এবং TAZ প্রোটিন এমন কিছু জিনকে উদ্দীপিত করে যার থেকে টিউমার কোষ তৈরি করে লিভারে। অনেক সময় দেখা গেছে ক্যানসারের সঙ্গেও যোগসূত্র রয়েছে এদের। বিজ্ঞানীরা বলছেন, হঠাৎ করেই এই দুই প্রোটিনের ক্ষরণ বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব নয়। তাহলে অন্যান্য শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়ায় এর প্রভাব পড়বে। এই দুই প্রোটিনের হম্বিতম্বি বন্ধ করার একমাত্র পথ হল এদের প্রভাবকে উল্টো পথে চালনা করা। সবজ ভাষায় বলতে গেলে, ভালো কোনও কিছু দিয়ে মন্দকে জব্দ করা। সেটা কী ভাবে? বিজ্ঞানীরা বলছেন, সেটা সম্ভব হবে আমাদের শরীরেরই একটি রাসায়নিক ‘ডোপামাইন’ দিয়ে।
লিভারের ভিলেনদের শায়েস্তা করবে মগজ থেকে বেরিয়ে আসা ডোপামাইন (Dopamine)
ডোপামাইন কী জানতে হলে মানুষের মস্তিষ্ক বা ব্রেনের গঠন একটু বুঝে নিতে হবে। আমাদের যাবতীয় কাজকর্ম, আবেগ, স্মৃতিশক্তি চালিত হয় ব্রেনের যে অংশ থেকে তাকে আমরা সহজ ভাষায় বলি ‘মিড ব্রেন’। এখানে থাকে যাবতীয় কাজকর্মের নিয়ন্ত্রক কালো রঙের পিগমেন্ট ‘নিউরো-মেলানিন’ (Neuromelanin)। আর রয়েছে কিছু নিউরন যার থেকে বেরিয়ে আসে ডোপামাইন। একে বলে নিউরোট্রান্সমিটার (Neurotransmitter) বা কেমিক্যাল মেসেঞ্জার (chemical messenger)। ডোপামাইনের ক্ষরণ যদি বেশি হয়, তা হলে তা আমাদের অনেক বেশি ক্ষিপ্র করে তোলে, আমাদের রিফ্লেক্স অ্যাকশন বা প্রতিবর্তী ক্রিয়ার গতি বাড়ায়। চনমনে, চঞ্চল রাখে। আবার ডোপামাইনের বেশি ক্ষরণ হলে যে কোনও ঘটনাতেই চট করে আমাদের চোখে জল এসে যায়। খুব সহজেই আমরা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। আর ডোপামাইনের ক্ষরণ কমে গেলে, স্মৃতিশক্তি নাশ, পারকিনসন্স ডিজিজের মতো মস্তিষ্কের জটিল রোগগুলি জন্ম নেয়।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, দেখা গেছে লিভারের ক্ষত থেকে তৈরি YAP এবং TAZ এই দুই প্রোটিন ডোপামাইনের রিসেপটর। কোনওভাবে যদি ডোপামাইন এই দুই প্রোটিনের উপর তার আধিপত্য বিস্তার করে পারে, তাহলে জ্বালাযন্ত্রণার বদলে আরামদায়ক অনুভূতি হবে মানুষের। ক্ষতিগ্রস্থ কোষগুলিকেও সারিয়ে তুলবে ডোপামাইন।
২০১২ সালেই একটি গবেষণায় প্রথম দেখা গিয়েছিল, মস্তিষ্কের মূলত তিনটি জায়গা থেকে ‘ডোপামাইন’ বেরিয়ে আসে। একটি ‘ভেন্ট্রাল টেগমেন্টাল এরিয়া’, দ্বিতীয়টি ‘সাবস্টানসিয়া নাইগ্রা’ আর তিন নম্বর জায়গাটি হল- ‘লোকাস সেরুলাস’। ‘অ্যাম্ফিটামিন’ নামে একটি ওষুধও ‘ডোপামাইন’-এর ক্ষরণ বাড়াতে সাহায্য করে। মেয়ো ক্লিনিকের বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ডোপামাইনকে জাগিয়ে তোলাই হবে একমাত্র কাজ। মানব শরীরের এই রাসায়নিকই লিভার সিরোসিসের যম। একে সঠিক পথে চালিত করতে পারলেই লিভারে যে কোনও জটিল রোগকে লহমায় সারিয়ে তোলা যাবে।