
অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার জব্দ হবে, সারবে সিরোসিস, কীভাবে সামলে রাখবেন লিভারকে
লিভারে অতিরিক্ত মেদ জমে ফ্যাটি লিভার, জ্বালাপোড়া বা প্রদাহ জনিত রোগ যা ভবিষ্যতে অনেক জটিল রোগের জন্ম দেয়। আর লিভারের শেষ পরিণতি হল সিরোসিস বা লিভারে ক্ষত।
সঞ্জীব আচার্য
কর্ণধার সিরাম অ্যানালিসিস
‘খাও খাও বুঁদ হয়ে ডুবে যাও’…
সেডেন্টারি লাইফস্টাইলের ইঁদুরদৌড় আর মদ্যপানে একেবারে ডুবে যাওয়া—শরীরের উপর তো আর কম অত্যাচার হয় না। কম ঘুম, নামমাত্র খাওয়া, কখনও প্রয়োজনের অতিরিক্ত খেয়ে ফেলা আবার কখনও দু’টো মিলের মধ্যে লম্বা সময়ের ব্যবধান, লিভারকে (Fatty Liver) নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছে। তার উপর সপ্তাহান্তে ছোট-বড় পার্টি, গাদা গাদা তেল মশলাদার খাবার আর আকণ্ঠ মদ্যপান তো রয়েছেই। খাবারের বোঝা থেকে লিভার যতটুকু শ্বাস নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে অ্যালকোহল সেই ফাঁকটা পুরোপুরি পুষিয়ে দেয়। যেটুকু ক্ষতি হওয়া বাকি ছিল তার ষোলোকলাই পূর্ণ করে দেয়। যার ফল অ্যালকোহল জনিত লিভারের রোগ, যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘অ্যালকোহল রিলেটেড লিভার ডিজিজ’ (ARLD)।
অ্যালকোহলের কারণে লিভারের যে হাঁসফাঁস অবস্থা হয় (Fatty Liver) তার আবার অনেক ধরন আছে। যেমন লিভারে অতিরিক্ত মেদ জমে ফ্যাটি লিভার, জ্বালাপোড়া বা প্রদাহ জনিত রোগ যা ভবিষ্যতে অনেক জটিল রোগের জন্ম দেয়। আর লিভারের শেষ পরিণতি হল সিরোসিস বা লিভারে ক্ষত। সোজাভাবে বলতে গেলে লিভারে দগদগে ঘা যার পরিণতি প্রাণঘাতীও হতে পারে।
অ্যালকোহল যেভাবে শেষ করে লিভারকে
মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান, শরীরচর্চার অভাব আর চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই একগাদা ওষুধ খেয়ে ফেলা, এইসবের পরিণতি ভয়ঙ্কর। গ্যাসট্রোএন্টেরোলজিস্টরা বলেন লিভারে মেদ (Fatty Liver) জমতে থাকা রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে। ক্রমশই তা বিরাট আকার ধারণ করে। যার থেকে অ্যালকোহলিক হেপাটাইটিস এবং অন্তিম পরিণতি লিভার সিরোসিস।
অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার (alcoholic fatty liver)— আমরা রোজ যে খাবার খাই তার থেকে পুষ্টিরস ছেঁকে নিয়ে বর্জ্য টক্সিনকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়াই লিভারের কাজ। এখন লিভারের ধাতে যা সয় না তেমন খাবার খেলে ফ্যাট তো জমবেই (Fatty Liver)। তার উপর রয়েছে অ্যালকোহল। সব মিলেমিশে জবরজং হয়ে লিভার ফুলতে শুরু করে। ইনফ্ল্যামেশন হয়। পরের ধাপ ফাইব্রোসিস। এই অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ (এএফএলডি)-এর চতুর্থ পর্যায় হল লিভার সিরোসিস বা লিভার ফেলিওর।
অ্যাকিউট অ্যালকোহলিক হেপাটাইটিস (acute alcoholic hepatitis)– এআরএলডি-র আরও একটা পর্যায় হল অ্যাকিউট অ্যালকোহলিক হেপাটাইটিস। জ্বালাপোড়ার মত যন্ত্রণা হয়। লিভার ফুলে যায়। এর ভিতরের কোষে সিস্ট জমা হতে শুরু করে। দেখা দেয় ফাইব্রোসিস। অনেক সময় এর থেকে হেপাটোসেলুলার কার্সিনোমা বা লিভারে ক্যানসারও দেখা দেয়।
অ্যালকোহলিক সিরোসিস (alcoholic cirrhosis)– লিভারের ফাইব্রোসিস (fibrosis) বা দগদগে ক্ষতের ফাইনাল স্টেজ হল সিরোসিস (Advanced Cirrhosis )। লিভারের কাজকর্মে ইতি তো টানেই, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খাড় করে দেয় যাবতীয় কোষ-কলাকে। সিরোসিস যদি ক্রনিক হয়ে যায়, তাহলে বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ। লিভার ক্যানসারকে নিমন্ত্রণ করে ডেকে আনে। অতিরিক্ত মদ্যপান, হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, ফ্যাটি লিভার (Fatty Liver), সিস্টিক ফাইব্রোসিস (cystic fibrosis), পিত্তথলির সমস্যা (biliary atresia) থেকেও সিরোসিস হয়।
লিভারের রোগ (Fatty Liver) জাঁকিয়ে বসছে বুঝবেন কী করে?
যে কোনও শারীরিক অসুস্থতার জন্য কথায় কথায় লিভারকে দায়ী করা হয়। বদহজমকেও অনেকে লিভারের রোগ বলে ধরে নেন। আদপে তা একেবারেই নয়। লিভারের কাজ ব্যহত হলে এবং অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হলে তখন কয়েকটি সাধারণ উপসর্গ দেখা দেয়। যেমন বমিভাব, খিদে কমে যাওয়া, ক্লান্তিভাব ডায়ারিয়া, জন্ডিস, পেট ফুলে ওঠা, ওজন কমতে শুরু করা, ত্বকে কালচে ছোপ, হাত ও পায়ের তলায় লালচে ভাব, হঠাৎ করেই জ্ঞান হারানো, ঘুমের সমস্যা, অনিদ্রা ইত্যাদি।
ফ্যাটি লিভার আগাম বোঝার কোনও উপায় নেই। খিদে কমে যাওয়া, বমি ভাব, গায়ে চুলকানির মতো সাধারণ কিছু লক্ষণ আছে তবে ফ্যাটি লিভার ধরা পড়ে ইউএসজি করাতে গিয়ে। ফ্যাটি লিভার ধরা পড়লেই রোগী কোন স্টেজে আছে দেখে নেওয়া হয়, চিকিৎসা শুরু হয় সেই মতো। যদি দেখা যায় রোগীর খাদ্যনালীর ভিতরে রক্তপাত হচ্ছে তাহলে ধরে নেওয়া হয় লিভারের দফারফা হয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে যকৃৎ প্রতিস্থাপন (Liver Transplant) ছাড়া কোনও উপায় থাকে না। এই পর্যায়ে রোগীর মৃত্যুর আশঙ্কাও বেশি।
অ্যালকোহল জনিত লিভারের রোগের কিছু কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর (Risk Factors) থাকে। এমন রোগীর চিকিৎসা করার সময় তার মেডিক্যাল হিস্ট্রি খতিয়ে দেখে নেন ডাক্তাররা।
যেমন-১) বংশগত বা ক্রনিক লিভারের রোগ থাকলে সেটা দেখে নেওয়া হয়।
২) জন্মগত কোনও ত্রুটি ও কিছু কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য লিভারের অসুখ হতে পারে।
৩) অতিরিক্ত অ্যালকোহল অবশ্যই লিভারের রোগের অন্যতম বড় কারণ।
৪) শরীরে বিপাকের হার কম, খাবারে পুষ্টি উপাদানের অভাব।
৫) উচ্চরক্তচাপ, হাইপারটেনশন লিভারের রোগ থেকেও জন্ম নেয়, কাজেই সেদিকেও সতর্ক থাকা উচিত।
লিভারের যে কোনও রোগই লাগামছাড়া হয়ে যায়, তাই এই টেস্টগুলো জরুরি
এআরএলডি শুধু নয় লিভার কতটা সুখে আছে জানতে কিছু রুটিন টেস্ট খুবই দরকার। এই পরীক্ষাগুলো করালে জটিল লিভারের রোগও প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে যায়।
১) কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (CBC)— লিভার কেমন আছে অন্যতম রাস্তা সিবিসি। রক্তে হিমাটোক্রিট, হিমোগ্লোবিন, শ্বেত রক্তকণিকা (হোয়াইট ব্লাড সেল্স বা ডব্লিউবিসি), লোহিত রক্তকণিকা (রেড ব্লাড সেল্স বা আরবিসি) ও অণুচক্রিকার (প্লেটলেট্স) সংখ্যা, তাদের বাড়া-কমা ধরা পড়ে এই পরীক্ষায়। ওই রক্তকণিকাগুলির পরিমাণে কমা-বাড়া বুঝেই পরবর্তী পদক্ষেপ করেন চিকিৎসকরা।
২) লিভার ফাংশন টেস্ট (Liver Function Test)— লিভার ফাংশন টেস্টের মধ্যে আছে অ্যালবুমিন (এএলবি), অ্যালামাইন ট্র্যান্স অ্যামাইলেজ (এএলটি),এএসটি বা অ্যাসপারটেট ট্র্যান্স অ্যামাইলেজ অ্যালকালাইন ফসফেট বা এএলপি, টোটাল বিলিরুবিন বা টিবিআইএল ইত্যাদি পরীক্ষা করা হয়। লিভার এনজাইমগুলির মাত্রার হেরফের হলে সেইমতো চিকিৎসা করেন ডাক্তাররা।
৩) অ্যাবডোমিনাল সিটি স্ক্যান (Abdominal CT Scan)—একে সিএটি স্যানও বলে। স্পেশালাইজ়ড এক্স-রে যার সাহায্যে শরীরের নির্দিষ্ট অংশের ক্রস-সেকশনাল ইমেজ ধরা পড়ে।
৪) অ্যাবডোমিনাল আলট্রাসাউন্ড (Abdominal Ultrasound)— হাই ফ্রিকুয়েন্সি সাউন্ড ওয়েব দিয়ে শরীরের অঙ্গল-প্রত্যঙ্গ এবং অ্যাবডোমেনের হালহকিকত দেখেন ডাক্তাররা।
৫) লিভার বায়োপসি (Liver Biopsy)— যকৃত কোষের কিছুটা অংশ বার করে নেওয়া হয়। পরে ল্যাবোরটরিতে পরীক্ষা করে দেখা হয় কোনও জটিল রোগ বাসা বেঁধেছে কিনা লিভারে। ক্যানসারের ঝুঁকি থাকলেও লিভার বায়োপসিতে সেটা ধরা পড়ে।
লিভারের রোগ টের পেতে কিছু এনজাইম-টেস্টও জরুরি, যেমন-
গামা-গ্লুটামাইলট্রান্সফারেজ (gamma-glutamyltransferase (GGT), অ্যাপপারটেট অ্যামাইনোট্রান্সফারেজ (aspartate aminotransferase (AST), অ্যালানিন অ্যামাইনোট্রান্সফারেজ (alanine aminotransferase (ALT)।
কীভাবে সামলে রাখবেন লিভারকে
• ডাক্তাররা বলেন লিভারের রোগের (Fatty Liver) তেমনভাবে ওষুধ হয় না। অ্যান্টিবায়োটিক অনেক আছে, তবে লাইফস্টাইলে বদল না আনলে রোগ ফের মাথাচাড়া দিতে পারে। কাজেই ডায়েটে সংযম, অ্যালকোহল থেকে দূরে থাকা অথবা মদ্যপান করলেও সেটা নির্দিষ্ট মাত্রায় রাখা এবং স্ট্রেস-ফ্রি চনমনে থাকাটা লিভারকে সুখে-শান্তিতে রাখার অন্যতম বড় টোটকা।
• ফ্যাটি লিভার ঠেকাতে লো ক্যালোরি ডায়েটে ভরসা রাখুন। ভাজা-তেলমশলা-মিষ্টি-ফাস্টফুড এ সব বাদ দিতে পারলেই ভাল। নিয়মিত শরীরচর্চা জরুরি।
• অতিরিক্ত অ্যালকোহলে আসক্তি থাকলে শরীরে ভিটামিন বি-কমপ্লেক্সের পরিমাণ কমে যায়। ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যায়। লিভার সিরোসিস ও লিভারের অন্যান্য রোগ ঠেকাতে তাই মদ্যপান ছাড়তেই হবে। একান্ত না পারলে প্রতি তিন মাস অন্তর লিভার ফাংশন টেস্ট করিয়ে নিতে হবে।
• এআরএলডি মানেই ভিটামিন এ-র অভাব। কাজেই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে হেলদি ডায়েট চার্ট মেনে চলা উচিত। নিজে নিজে ডাক্তারি নয়, লিভারের ওষুধের ক্ষেত্রেও বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
১০০ বছর অন্তর ফিরে আসছে মৃত্যুর কালো ছায়া, বিউবনিক প্লেগের উৎস খুঁজে পেলেন বিজ্ঞানীরা