
দেরিতে হাঁটা শিখছে বাচ্চা, পায়ের পাতা বাঁকা, সদ্যোজাতর হাড়ে সমস্যা, সমাধান আছে কলকাতাতেই
দ্য ওয়াল ব্যুরো: বাচ্চাদের পায়ের হাড়ে নানা সমস্যা দেখা দেয়। এমনিতে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রোথ পেন তো থাকেই, তাছাড়া কখনও হাড়ে ইনফেকশন, ফ্র্যাকচার ইত্যাদিও ভোগায়। অনেক বাচ্চার আবার পায়ের পাতা, হাঁটু বাকা হয়। স্বাভাবিকভাবেই বাবা-মায়েরা ভয় পেয়ে যান। এখন তো আবার করোনার কারণে স্কুল, খেলাধুলো বন্ধ। শারীরিক কসরতও কম হচ্ছে। এমন সময় বাচ্চাদের যত্ন নেবেন কী করে, হাড়ে সমস্যা বুঝবেন কী করে, এইসব কিছু নিয়ে দ্য ওয়ালের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন বিশিষ্ট পেডিয়াট্রিক অর্থোপেডিক সার্জেন ডক্টর সৌম্য পাইক।
বাচ্চাদের হাড়ে কী কী সমস্যা হয়?
বাচ্চাদের হাড় হল গ্রোয়িং বোন। অনেক নরম হয়। বেড়ে ওঠার সময় গ্রোয়িং স্টেজে পায়ে ব্যাথা হয় অনেকের। তবে একটা বয়সের পরে গ্রোথ পেন চলে যায়। তাছাড়া বাচ্চাদের পায়ের হাড়ে ফ্র্যাকচার হয়, অনেকের হাঁটুর বা পায়ের পাতা বাঁকা হয়। তার জন্য আলাদা চিকিৎসা আছে। শিশুদের হাড়ের সমস্যা বা পেডিয়াট্রিক অর্থোপেডিকের চিকিৎসা অ্যাডাল্ট অর্থোপেডিকের থেকে একদমই আলাদা। মেডিসিনও অন্যরকম। বাচ্চাদের জ্বর হলে যেমন প্যারাসিটামলের অর্ধেক ডোজ দিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু অর্থোপেডিক সমস্যা হলে বড়দের ওষুধের অর্ধেক দিয়ে চিকিৎসা হয় না। গোটা থেরাপিটাই অন্যরকম।
বাচ্চাদের ফ্র্যাকচার হলে তা কতটা ভয়ের?
বাচ্চাদের হাড়ে ফ্র্যাকচার হলে তার ট্রিটমেন্ট, প্রোটোকল আলাদা। অনেক সময় দেখা যায়, বড়দের থাই বোনে ফ্র্যাকচার হলে সার্জারি করা হয়, কিন্তু বাচ্চাদের হলে সেটা করার দরকার নাও পড়তে পারে। বাচ্চাদের হাড়ের ক্ষেত্রে ‘রিমডেলিং পোটেনশিয়াল’ বলে একটা কথা আছে। বাচ্চাদের খুব তাড়াতাড়ি জোড়া লেগে যায়, তবে সঠিকভাবে জোড়া লাগানো জরুরি হয়ে পড়ে। সব বাচ্চার যে সার্জারি করতে হবে তেমন নয়, বাচ্চাদের অনেক সময় প্লাস্টারেও সেরে যায়। প্লাস্টার ট্রিটমেন্টও একটু জটিল। বাচ্চাদের বয়স ও হাড়ের অবস্থান দেখে চিকিৎসা করতে হয়। তাই শুধু এক্স-রে দেখে ফ্র্যাকচার সেরে গেছে বলা ঠিক নয়। মাথায় রাখতে হবে অ্যাডাল্ট ফ্র্যাকচার ও পেডিয়াট্রিক ফ্র্যাকচারের ধরন আলাদা, তাই দুইয়ের চিকিৎসার প্রোটোকলও আলাদা হবে। এক্স-রেই একমাত্র গাইডলাইন নয়।
অনেক বাচ্চার পায়ের পাতা বাঁকা হয়, এর কারণ কী, চিকিৎসাই বা কী?
জন্মগত পা বাঁকাকে বলা হয় ‘ক্লাব ফুট’। এটা প্রতি এক হাজার বাচ্চার মধ্যে একজনের দেখা যায়, চিকিৎসায় সেরেও যায়। একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে পায়ে প্লাস্টার করা হয়, বিশেষ রকম জুতোও দেওয়া হয় বাচ্চাদের। ট্রিটমেন্টের পরে অন্তত চার বছর পর্যবেক্ষণে রাখা। পায়ের পাতা বাঁকা ছাড়াও আরও অনেক রকম সমস্যা দেখা দেয়, সেগুলোর আলাদা আলাদা ডিভিশন আছে। বাচ্চাদের বয়স, হাড়ের পজিশন ইত্যাদি সব দেখে ট্রিটমেন্ট করা হয়।
ছোট বাচ্চাদের হাঁটু বাঁকা হয় অনেক সময়। এটা কখন অস্বাভাবিক?
বাচ্চার জন্মের পরে দু’তিন বছর বয়স অবধি দেখা যায় হাঁটু ধনুকের মতো বাঁকা, একে ডাক্তারি ভাষায় বলে ‘বো লেগড’ (Bow Legged)। আবার ওই বাচ্চারই চার থেকে সাত বছর বয়স হলে দেখা যায়, পা দুটো উল্টো দিকে বেঁকে গেছে, একে বলে ‘নক নি’ (Knock-Knee)। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বো-লেগস কোনও জটিল চিকিৎসা ছাড়াই সেরে যায়। তবে তার একটা ভ্যারাইটি আছে, দু’দিকে সিমেট্রিকাল হয়, ১০-১৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল হতে হয়, কিছু স্পেশালিটি থাকে যেগুলো হলে ডাক্তারের নির্দেশ মেনে চললে একদমই সেরে যায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় বাঁকাটা অনেকটা বেশি, তখন চিকিৎসার দরকার হয়। ধরা যাক, একটা ছোট বাচ্চার দুই পায়ে ২০-৩০ ডিগ্রি বাঁকা রয়েছে, বড় হলে সেটাই আবার ৪০-৫০ ডিগ্রি হয়ে যাবে। তখন বিপদ আরও বাড়বে। হাড়ের যা ক্ষতি হওয়ার তা অনেকটাই হয়ে যাবে। তাই আগে থেকে সতর্ক থাকাটা জরুরি।
মালিশ করে বাচ্চার পায়ের হাড়ের সমস্যা ঠিক করা কি সম্ভব?
অনেক মায়েরাই বলেন, ছোটবেলায় ঠিক করে মালিশ না করায় হয়ত বাচ্চার পা বাঁকা হয়েছে। আসলে এই ধারণাটা একেবারেই ভুল। মালিশ না করালে পা বাঁকা হবে বা পাঁ বাঁকা থাকলে তা মালিশে ঠিক হবে, এমনটা নয়। অনেক রোগীকে দেখা গেছে, খুব জোরে মালিশ করার কারণে পায়ের হাড়ে ফ্র্যাকচার হয়ে গেছে। তাই মালিশে যে বিশাল উপকার হবে তেমনটা নয়।
বাচ্চার পায়ের সমস্যায় বিশেষ জুতোর ভূমিকা কতটা?
বাচ্চাদের এখন ‘ফ্ল্যাট ফুট’ এর সমস্যা বেশি। অনেক বাবা মা-ই এই ফ্ল্যাট ফুটের সমস্যা নিয়ে আসেন। আসলে, এই ফ্ল্যাট ফুট ব্যাপারটা আগে বিদেশে বেশি দেখা যেত। তার জন্য বিশেষ রকম জুতো দিতেন ডাক্তারবাবুরা। আমাদের দেশে বেয়ার ফুট বা খালি পায়ে হাঁটার ব্যাপারটা বেশি ছিল। খালি পায়ে হাঁটার একটা উপকারিতাও আছে। তাই সবসময় যে বিশেষ জুতো পরতেই হবে তেমনটা নয়। যদি তেমন দরকার হয়, তখন জুতো প্রেসক্রাইব করা হয়।
বাচ্চাদের ব্যাক পেন, নেক পেনের সমস্যা বাড়ছে, কী করা উচিত?
করোনা, লকডাউনের কারণে এখন স্কুল বন্ধ। বাচ্চাদের খেলাধুলোও বন্ধ হয়ে গেছে। সারাদিন কম্পিউটার বা মোবাইলে অনলাইন ক্লাস চলছে। তাই এই ধরনের সমস্যা আরও বাড়ছে। আমাদের সিস্টেম দু’পায়ে হাঁটাচলার জন্য তৈরি হয়েছে, বসে থাকার জন্য নয়। তাই এই সিস্টেম ব্রেক করলে সমস্যা হবেই। তাই যারা সবসময় বসে থাকে, তাদের ব্যাক পেনের সমস্যা বাড়ে।
আগে বাবা-মায়েরা বলতেন, বাচ্চারা ভারী স্কুলব্যাগ নিয়ে যায়, সে কারণে ব্যাক পেনের সমস্যা বাড়ছে। আসলে স্কুলব্যাগটা হয়ত সমস্যা নয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাচ্চারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা গ্যাজেট ব্যবহার করছে। একটানা বসে মোবাইলে গেম খেলছে। তখন ব্যাক পেন, নেক পেনের সমস্যা বাড়ে। এর সমাধান হচ্ছে, শরীরের নড়াচড়া বা মুভমেন্ট দরকার। বাবা-মায়েদের খেয়াল রাখতে হবে অনলাইন ক্লাস করলেও বাচ্চারা যেন দীর্ঘসময় একটানা বসে না থাকে, শরীরের কিছুটা মুভমেন্ট দরকার। আর একটা সমস্যা হল ভিটামিন ডি-এর অভাব। আগে বাচ্চারা বাইরে খেলতে যেত, এখন সেটা বন্ধ। বাবা-মায়েদের বার বার করে বলতে হয় বাচ্চাদের অন্তত কিছু সময় বাইরে নিয়ে যান, সূর্যের আলো গায়ে লাগানোও দরকার। এখন কোভিড পরিস্থিতিতে বিধি মেনেই বাচ্চাদের কিছু সময়ের জন্য সকালে বা বিকেলে বাইরে নিয়ে যান, আলো-হাওয়া গায়ে লাগানোও দরকার। আর যে কোনও গ্যাজেট, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, মোবাইল যতটা কম সম্ভব ব্যবহার করা দরকার।
বাচ্চার হাঁটা শুরু হতে কত দেরি হতে পারে? কখন বুঝব, ডাক্তার দেখানো উচিত?
বাচ্চা সাধারণত এক বছরে হাঁটতে শুরু করে। দেড় থেকে দু’বছরের মধ্যে যদি বাচ্চা হাঁটা শুরু না করে, তখন সচেতন হতে হবে। বাচ্চা মোটামুটি ছ’মাস বয়সে বসে এবং এক বছরের মধ্যে দাঁড়িয়ে যায়। আজকালকার দিনে একটা নতুন রোগ আসছে যার নাম সেরিব্রাল পলসি। আগেও ছিল, তবে এখন সংখ্যায় বেশি। আগে দেখা যেত খুব কম ওজনের বাচ্চা যেমন ৫০০ গ্রাম, এক কেজি হলে বাঁচত না। এখন অনেক মেডিক্যাল সেটআপ আছে। তবে প্রি-টার্ম বাচ্চাদের ক্ষেত্রে যাদের জন্মের সময় ওজন খুব কম ছিল, বাচ্চা কাঁদেনি বা দীর্ঘসময় আইসিইউতে রাখতে হয়েছে, তারা যদি ছ’মাসে না বসে বা এক-দেড় বছরের পরেও অন্যের সাহায্য ছাড়া নিজে হাঁটার অভ্যাস তৈরি করতে না পারে, তাহলে সেই বাচ্চা সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত হলেও হতে পারে। তখন দেরি না করেই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
বাচ্চা যদি অস্বাভাবিক ভাবে হাঁটে, গোড়ালি মাটিতে না ফেলে পা উঁচু করে হাঁটে, তখন কী করণীয়?
বাচ্চার পা উঁচু করে চলাকে বলে ‘টো ওয়াকিং’ (Toe Walking)। অনেক সময় এই সমস্যা বাচ্চার দেড় থেকে দু’বছর বয়স হলে সেরে যায়। কিন্তু এই টো ওয়াকিং খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত বাবা-মায়ের। যদি দেখা যায়, বাচ্চা এক পায়ের গোড়ালি তুলে হাঁটছে, তাহলে সতর্ক হতে হবে, কারণ বুঝতে হবে নিশ্চয়ই বাচ্চাটির পায়ের হাড়ে সমস্যা আছে। আবার দেখা যায়, জন্মের পরে বাচ্চার হিপ জয়েন্টে সমস্যা হয়, স্পাইন বা স্নায়ুর সমস্যা থাকে। তার জন্য এই টো ওয়াকিং হতে পারে।
বাচ্চার বসার ধরন দেখে কি বোঝা সম্ভব, তার পায়ের হাড়ে সমস্যা আছে কিনা?
বাচ্চা অনেক সময় ব্যাঙের মতো বসে যাকে ডাক্তারি ভাষায় বলে ‘ডব্লিউ সিটিং’ (W-Sitting)। এই সমস্যা তখনই হয় যদি বাচ্চাদের কোমরে সমস্যা থাকে। এমন হলে বাচ্চাকে বাবু হয়ে বসতে শেখানো উচিত। যদি দেখা যায় তার পরেও বাচ্চা ব্যাঙের মতো বা বজ্রাসনে বসছে, তখন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা উচিত।
হাড়ের ইনফেকশন কী ছোট বাচ্চাদেরও হয়?
বড়দের হাড়ে ইনফেকশন হলে অনেকগুলো লক্ষণ দেখা যায়, যেমন জ্বর আসে, সে জায়গাটা ফুলে যায়, ব্যথা হয়। যদি সদ্যোজাত বাচ্চা হয়, তাহলে এইসব উপসর্গ নাও দেখা যেতে পারে। হয়ত দেখা যাবে, বাচ্চার জ্বর নেই, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সংক্রমণ হচ্ছে। যেহেতু খুব ছোট বাচ্চা তাই যন্ত্রণা হলেও বলতে পারবে না।
সাধারণত দেখা যায়, ছোট বাচ্চাদের কোমরের জয়েন্টে সমস্যা থাকে, একে সেপটিক হিপ জয়েন্ট (septic hip joint) বলে। জয়েন্টের জায়গায় ইনফেকশন হয়। যদি সদ্যোজাত বাচ্চা হয়, এবং তার সেপটিক হিপ জয়েন্ট থাকে, তাহলে দেখা যাবে ন্যাপি বদলাতে যাওয়ার সময় বাচ্চার পায়ে লাগছে। ব্যথা পেয়ে কাঁদছে। এই একটাই লক্ষণ দেখে বুঝতে হবে। তখন দেরি করা ঠিক হবে না, খুব দ্রুত ট্রিটমেন্ট শুরু করতে হবে, তা না হলে দীর্ঘসময়ব্যাপী ক্ষতি হতে পারে। অনেক সময় মা ভাবেন বাচ্চা অনেকক্ষণ পা মুড়ে রয়েছে তাই ব্যাথা হচ্ছে, এই ব্যাপারটা এড়িয়ে যান। কিন্তু সেটা করা ঠিক হবে না। খেয়াল করে সময়মতো ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। শিশুদের কোনও সমস্যাই অবহেলা করা ঠিক হবে না।