
রিউমাটোলজি: বাতের ব্যথার কী কী চিকিৎসা আছে, আধুনিক থেরাপিতে রোগমুক্ত থাকা সম্ভব
চৈতালী চক্রবর্তী
বাতের ব্যথা বা গাঁটে-গাঁটে যন্ত্রণা এখন আর বয়স বিচার করে আসে না। ছোটাছুটির জীবনে শারীরিক ক্লান্তি যতটা, তার থেকেও বেশি মানসিক চাপ। এই দুয়ের জাঁতাকলে পড়েই নানানটা রোগ। গাঁটে গাঁটে ব্যথা তো আছেই। উঠতে-বসতে হাঁটুতে অসহ্য যন্ত্রণা। মনে হয় কে যেন বেতের ঘা বসিয়ে দিয়েছে। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলে পায়ের পাতাও ফুলেফেঁপে একসার। অস্থিসন্ধিতে ব্যথা তো আছেই, শরীরের নানা অঙ্গও ভুগছে একই সঙ্গে। এই বাতের ব্যথা কখনওই সম্পূর্ণ সারে না। তবে ইদানীংকালে নানা আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতিতে ব্যথার তীব্রতা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। নতুন নতুন ওষুধে যন্ত্রণাও বশে থাকে অনেকটাই। বাতের ব্যথার উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি এবং বাত সংক্রান্ত ডাক্তারিবিদ্যা তথা রিউমাটোলজি নিয়ে বিশদে আলোচনা করলেন অ্যাপোলো মাল্টিস্পেশালিটি হসপিটালের কনসালট্যান্ট রিউমাটোলজিস্ট ডক্টর শ্যামাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়।
কেন হয় বাতের ব্যথা?
বিভিন্ন হাড়ের সংযোগস্থলকে বলা হয় অস্থিসন্ধি। সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হলেই বাতের ব্যথা শুরু হয়। অস্থিসন্ধি বা দু’টি হাড়ের সংযোগস্থলে অর্থাৎ হাড়ের আগায় সাদা রঙের রবারের মতো দু’টি তন্তুর মতো বস্তু থাকে। এদের কাজ অস্থিসন্ধির দু’টি হাড়ের মধ্যে ঘর্ষণ কমানো। তা ছাড়া কোনও আঘাত লাগলে এগুলি ‘শক অ্যাবজরভার’ হিসাবে কাজ করে। এই সাদা তন্তুর মতো বস্তুকে বলে কার্টিলেজ (Cartilage)। এই কার্টিলেজগুলি ক্রমশ ক্ষয়ে যেতে শুরু করলে বাতের সমস্যা শুরু হয়। ঠিকমতো শরীরচর্চা না করা, শারীরিক পরিশ্রমে অনীহা, একটানা দাঁড়িয়ে বা বসে কাজ, অনিয়ন্ত্রিত খাওয়াদাওয়া এই রোগকে নিমন্ত্রণ করে ডেকে আনে।
জানেন তো বাতের ব্যথা শরীরের অন্যান্য অঙ্গগুলোকে প্রভাবিত করে!
বাতের ব্যথা বা জয়েন্ট পেন শুধু অস্থিসন্থির ইনফ্ল্যামেশন বা প্রদাহ ঘটায় এমন নয়, শরীরের অন্যান্য অঙ্গগুলোতেও এর প্রভাব পড়ে। প্রাথমিক ভাবে অস্থিসন্ধিতে ব্যথা থেকে শুরু হয়। এর পরে ধীরে ধীরে অস্থিসন্ধির সচলতা কমে যায়। এ ভাবে চলতে চলতে কারও কারও ক্ষেত্রে অস্থিসন্ধির হাড়গুলি হালকা বেঁকেও পর্যন্ত যেতে পারে। তখন হাঁটু মুড়ে বসতে, সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে, অনেকক্ষণ হাঁটাচলা করতে সমস্যা দেখা দেয়। এইভাবে অস্থিসন্ধিতে যে ইনফ্ল্যামেশন তৈরি হবে তা হার্ট, লিভার, কিডনি সহ শরীরের অন্যান্য অঙ্গেও প্রদাহ তৈরি করবে।
এই প্রসঙ্গে বলা ভাল, বাতের ব্যথাকে আমরা অনেকগুলো ভাগে ভাগ করতে পারি, যার মধ্যে অস্টিওআর্থ্রাইটিস ও রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের নামই বেশি শোনা যায়। এই রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস জাঁকিয়ে বসলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অতিসক্রিয় হয়ে ওঠে। এই অতিসক্রিয়তা অস্থিসন্ধির কার্টিলেজে প্রভাব ফেলে। কার্টিলেজ ক্ষয়ে বাতের ব্যথা শুরু হয়। তখন শরীরের ছোট ছোট জয়েন্টগুলোতে প্রদাহ তৈরি হতে থাকে। একই সঙ্গে হার্ট, লিভার, ত্বক, কিডনির ওপরে প্রভাব পড়ে। যদি সঠিক চিকিৎসা না করা হয় তাহলে ব্যথা তো বাড়বেই অন্যান্য সমস্যাও দেখা দেবে। বিশেষ করে ব্যথা উপশমের জন্য যে ধরনের ব্যথানাশক ওষুধ বা পেন কিলার খাওয়া হয় তা কিডনির অসুখের ঝুঁকি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়।
বাতের ব্যথার চিকিৎসা ধাপে ধাপে উন্নত ও আধুনিক হয়েছে। শুরুতে যে পদ্ধথি চিকিৎসা হত বা যে ধরনের ওষুধ দেওয়া হত, এখন তা অনেকটাই বদলেছে।
![Exercise can ease rheumatoid arthritis pain - Harvard Health]()
ডিমার্ড (DMard) পদ্ধতিতে বাতের ব্যথার ট্রিটমেন্ট হত একসময়
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসার জন্য অস্থসন্ধির ক্ষয় রুখে যন্ত্রণা কমানোর জন্য এক ধরনের ওষুধের থেরাপি করা হত যার নাম ‘ডিজিজ-মডিফাইং অ্যান্টিরিউমাটিক ড্রাগ’ (DMARDs)।
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস প্রথমে ছোট জয়েন্টগুলির ক্ষতি করে। অর্থাৎ আঙুল আর হাতের জয়েন্ট বা পায়ের আঙুলের সঙ্গে পায়ের পাতার অস্থিসন্ধি। রোগ যত বাড়তে থাকে হাঁটু, গোড়ালি, কব্জি, কনুই, কাঁধে ব্যথা বাড়তে থাকে। অনেকের ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে ত্বক, চোখ, ফুসফুস, হার্ট, কিডনি অথবা স্যালাইভারি গ্ল্যান্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অস্থিমজ্জাও ক্ষতিগ্রস্থ হয় রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে। এই ধরনের বাতের বাড়বৃদ্ধি বন্ধ করার জন্যই এই ‘ডিজিজ-মডিফাইং’ ওষুধ ব্যবহার করা হত। এগুলোর মধ্যে সালফ্যাসালাজিন, লেফলুনোমাইড, মেথোট্রিক্সেট, মাইলোসাইক্লিন, অ্যাজাথিওপ্রিন, সাইক্লোস্পোরিন ইত্যাদি আছে। তবে এই সমস্ত ওষুধের একের বেশি প্রয়োগ হয়। অর্থাৎ একই ওষুধ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় কাজে লাগে, যেমন–অ্যাজাথিওপ্রিন, মেথোট্রিক্সেট বাতের ব্যথার সঙ্গে ক্যানসারের চিকিৎসাতেও কাজে লাগে, আবার সাইক্লোস্পোরিন ওষুধ বিভিন্ন রকম অঙ্গ প্রতিস্থাপনে ব্যবহার করা হয়। ডিজিজ-মডিফাইং ওষুধের সঙ্গেই স্টেরয়েডের ব্যবহারও শুরু হয় রিউমাটয়েড বা অটোইমিউন রোগের চিকিৎসায়। স্টেরয়েডের নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা তো অনেকেরই জানা।
বায়োলজিক এজেন্ট চিকিৎসার মোড়ই ঘুরিয়ে দেয়
বায়োলজিক এজেন্ট হল এক ধরনের ডিজিজ-মডিফাইং ড্রাগ যা আসলে অ্যান্টিবডি গোত্রের ওষুধ। এর কাজ হল শরীরের ইনফ্ল্যামেশন বা প্রদাহকে রুখে দেওয়া। এই ধরনের অ্যান্টিবডি গোত্রের ওষুধ বাতের চিকিৎসায় নবদিগন্তের সূচনা করল।
বায়োলজিক এজেন্টের কাজ হল কোষের অতিসক্রিয়তাকে রুখে দেওয়া। অটোইমিউন ডিজিজের তীব্রতাকে কমিয়ে দেওয়া। অটোইমিউন ডিজিজ তখনই হয় যখন আমাদের নীজের শরীরের কোষই অন্যান্য কোষগুলিকে চিনতে পারে না। কোষ দেখতে ছোট হলেও তার মধ্যে নানারকম রাসায়নিক প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এক কোষ থেকে অন্য কোষের মধ্যে আদানু্রদান হতে থাকে। কিন্তু যদি দেখা যায়, একটি কোষ অপর কোষকে চিনতে পারছে না এবং যার ফলে আদানপ্রদানের প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে বা কোষ ভুল সঙ্কেত পাঠাচ্ছে, তাহলে যে ধরনের রোগ দেখা দেয় তাকেই অটোইমিউন ডিজিজ বলে। এর ফলে কোষে কোষে তীব্র প্রদাহ বা ইনফ্ল্যামেশন তৈরি হয়। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের যা অন্যতম প্রধান কারণ। বায়োলজিক এজেন্ট এই ইনফ্ল্যামেশনকে রুখে দেয়। বেলিমুবাব, ক্যানাকিনুমাব, সার্টোলিজুমাব, রিটুক্সিমাব ইত্যাদি নানা ধরনের বায়োলজিক এজেন্ট আছে যা বাতের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়।
সঠিক চিকিৎসা হলে দীর্ঘ সময় ওষুধ খেতে হবে না রোগীকে
সবচেয়ে আগে দরকার রোগ চিহ্নিতকরণ, তার পরে চিকিৎসা। সঠিক ডায়াগনসিস হলে চিকিৎসাও নির্ভুল পদ্ধতিতে করা সম্ভব। বাতের ব্যথা কখনওই সম্পূর্ণ নিরাময় হয় না, তবে ঠিকমতো চিকিৎসা হলে দীর্ঘ সময় রোগী ওষুধ না খেয়েও সুস্থ থাকতে পারে। তাছাড়া ওষুধের পাশাপাশি নিয়মিত ফিজিওথেরাপি করাতে হবে। নির্দিষ্ট কিছু ব্যায়াম (অবশ্যই বিশেষজ্ঞদের দেখানো) ও ফিজিওথেরাপি করলে অস্থিসন্ধি সচল থাকবে। ব্যথাও অনেকটা কমবে। তা ছাড়া ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখাটা খুবই জরুরি। ওজন বশে থাকলে অস্থিসন্ধির উপরে চাপ অনেকটাই কমে যাবে। ফলে অস্থিসন্ধির ভিতরে থাকা কার্টিলেজের আরও ক্ষয়ে যাওয়ার আশঙ্কা কমে এবং ব্যথাও কমে যায়।