বন্ধ্যত্বের বড় শত্রু দুশ্চিন্তা, দোষারোপ, ভয়! প্রয়োজন পারস্পরিক বোঝাপড়া ও বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা

অনিয়মিত জীবনযাপন, দুশ্চিন্তা, ছুটে চলা, পারিপার্শ্বিক সমস্যা– সব মিলিয়ে এই সময়টা অনেকের জন্যই খুব একটা নিশ্চিত বা আরামদায়ক নয়। শরীর বা মন, দুইয়ের ওপরেই অনেকটা বেশি চাপ। এমন অবস্থায় একটা বড় সমস্যা বন্ধ্যত্ব? বহু দম্পতি ভুগছেন গর্ভধারণ না করতে পারার সমস্যায়। কিন্তু এই সমস্যা কখন আদতেই ‘বন্ধ্যত্ব’, তা কী করে বুঝবেন? কী করেই বা সুস্থ ও সবল পদ্ধতিতে গর্ভধারণ করবেন কাঙ্ক্ষিত সময়ে। সমস্যা বুঝলে তার সমাধান কী কী– এই সবটা নিয়ে দ্য ওয়ালের প্রতিনিধি তিয়াষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনায় রয়েছেন ক্রেডেল ফার্টিলিটি সেন্টারের স্ত্রীরোগ ও বন্ধ্যত্ব বিশেষজ্ঞ ডক্টর এস এম রহমান এবং ডক্টর দিশারী দাস।

দ্য ওয়াল: কেউ কখন নিজেকে ‘বন্ধ্যা’ ভাববেন, বা বন্ধ্যত্বের চিকিৎসা শুরু করার কথা ভাববেন?

ডক্টর: এটা জানাটা খুব জরুরি। কারণ কোন পরিস্থিতি সাময়িক আর কোন পরিস্থিতি আদতেই ‘বন্ধ্যত্ব’, বা কোন সময় থেকে চিকিৎসা জরুরি, আমাদের কাছে আসা জরুরি, তা আগে জানতে হবে। আমরা অনেক সময়েই দেখি বিয়ের কয়েক মাস পরেই আমাদের চেম্বারে এসে হাজির উদ্বিগ্ন তরুণ-তরুণী। তাঁদের ধারণা, তাঁরা ইনফার্টিলিটি সমস্যার শিকার। বেশিরভাগ সময়েই এটা ভুল হয়।

আমরা সাধারণত বলি, এক বছর ধরে কোনও রকম প্রোটেকশন ছাড়া নিয়মিত সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স করেও যদি গর্ভধারণ না হয়, তাহলে আমাদের কাছে আসা যেতে পারে। তার আগে অন্তত এক বছর ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করা উচিত। তবে কোনও মহিলার যদি ৩৫ বছর বয়স হয়, তবে সেক্ষেত্রে ৬ মাস চেষ্টা করার পরেও যদি গর্ভধারণ না হয়, তবে আমাদের কাছে আসা উচিত। আমরা টেস্ট করে দেখে সমস্যা বোঝার চেষ্টা করব। কারণ ৩৫ বছরের পরে দেরি করলে তা অনেক ক্ষেত্রে সমস্যাজনক হয়।

What to Say and Not Say to Someone Living With Infertility ...

দ্য ওয়াল: প্রাইমারি বা সেকেন্ডারি ইনফার্টিলিটি কাকে বলে?

ডক্টর: যে সমস্ত দম্পতি একবারও গর্ভধারণ করেননি, প্রথম বার বাচ্চার জন্য চেষ্টা করছেন, কিছুতেই বাচ্চা আসছে না, তাঁদের ক্ষেত্রে ইনফার্টিলিটির সমস্যাটা প্রাইমারি। কিন্তু অনেক সময়ে দেখা যায় আগে হয়তো গর্ভধারণ হয়েছিল, কোনও কারণে গর্ভপাত হয়ে গেছে বা কারও হয়তো একটি সন্তান রয়েছে, তাঁরা দ্বিতীয় সন্তানের জন্য চেষ্টা করেও কিছুতেই সফল হচ্ছেন না, তাঁদের ক্ষেত্রে এটা সেকেন্ডারি ইনফার্টিলিটি। এই দু’ধরনের ক্ষেত্রেই দম্পতিরা আমাদের কাছে আসতে পারেন।

দ্য ওয়াল: একটা ধারণা আছে, বন্ধ্যত্বের সমস্যা কেবল মেয়েদেরই। এমনটা কি সত্যি?

ডক্টর: একেবারেই না। এটা ভীষণ ভাবে ভুল ধারণা। সেইসঙ্গে এটা একটা সামাজিক ভাবে চাপিয়ে দেওয়া তত্ত্বও বটে। আমরা দেখে থাকি, কোনও দম্পতি যখন ইনফার্টিলিটির সমস্যায় ভুগছেন, তখন তার এক তৃতীয়াংশ কারণ থাকে মেয়েদের কোনও সমস্যা, এক তৃতীয়াংশ ছেলেদের, আর অন্য এক তৃতীয়াংশ ছেলে ও মেয়ে দু’জনেরই সমস্যা।

তাই এমনটাও মনে করা যায়, কোনও বন্ধ্যত্ব সমস্যার ক্ষেত্রে দুই তৃতীয়াংশ দায়ও ছেলেদের থাকতে পারে। ফলে সমস্যা সমাধান করার জন্য যদি শুধু মেয়েদেরই পরীক্ষা করা হয়, তাহলে তা শুধু অকারণ নয়, তাদের প্রতি বোঝাও বাড়িয়ে দেওয়া। আমাদেরও সমস্যায় পড়তে হয় ইনফার্টিলিটি কারণটা বুঝতে।

দ্য ওয়াল: ছেলেদের সমস্যা সাধারণত কতটা?

ডক্টর: কোনও কোনও বন্ধ্যত্ব সমস্যার ক্ষেত্রে দুই তৃতীয়াংশ দায়ও ছেলেদের থাকতে পারে। এই কথাটা আমরা বারবার বলছি, জোর দিচ্ছি, তার কারণটা এটাই, যে বন্ধ্যত্বের চিকিৎসা করার সময়ে দম্পতি হিসেবেই করতে হবে। শুধু মেল পার্টনার বা ফিমেল পার্টনারকে ‘অক্ষম’ বলে দেগে দিলে হবে না। দু’জনের জন্যই বিশেষ কিছু টেস্ট রয়েছে, যা আগে করে দেখতে হবে। তবেই আমরা নির্দিষ্ট করে সমস্যা বুঝতে পারব। সেটা বুঝতে পারলে তবেই সমাধান হবে। এটা একটা সামগ্রিক চেষ্টা। কাউকে বিচ্ছিন্ন করলে হবে না।

Infertility | womenshealth.gov

দ্য ওয়াল: এই পরীক্ষানিরীক্ষার পর্ব কি খুব জটিল? অনেক খরচ?

ডক্টর: আমরা একেবারে প্রথমে কিছু বেসলাইন টেস্ট করি। মেয়েদের ক্ষেত্রে একটা আল্ট্রাসোনোগ্রাফি, কিছু হরমোনাল টেস্ট, সুগার, থাইরয়েড টেস্ট– এগুলো করা হয়। এখান থেকে একটা প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়। এর পরে পরবর্তী ধাপ ঠিক করা হয়। প্রথমেই যে অনেক টেস্ট করতে হয়, তা নয়। আর এর পদ্ধতি খুব ভয় পেয়ে যাওয়ার মতোও নয়। তেমন কোনও ধকলও নেই।

ইনফার্টিলিটির ক্ষেত্রে আসলে বেসিক চারটে জায়গা দেখতে হয়। মেয়েদের ইউটেরাস, ওভারি, ফ্যালপিয়ান টিউব, ছেলেদের স্পার্ম। এই চারটে ক্ষেত্রে কোনও মেজর অস্বাভাবিকত্ব আছে কিনা, আমরা বোঝার চেষ্টা করি আগে। এগুলো প্রাথমিক টেস্ট করে বোঝা যায়।

Sterility and Infertility: What Is the Difference? – NOVA IVI ...

দ্য ওয়াল: সন্তানের জন্ম দেওয়া নিয়ে সামাজিক ভাবে তৈরি করা চাপ কি বন্ধ্যত্বের একটা কারণ হয়ে ওঠে?

ডক্টর: অবশ্যই। গর্ভধারণ করতে চাইলে দম্পতির স্ট্রেস কমানো এমনিতেই জরুরি। স্ট্রেস একটা মারাত্মক ফ্যাক্টর ইনফার্টিলিটির ক্ষেত্রে। আর এই স্ট্রেস অনেক বেড়ে যায় মহিলাদের দোষারোপ করার সামাজিক অভ্যেসের কারণে। মেয়েদের গঞ্জনা সহ্য করা মানসিক ভাবে সমস্যা তৈরি করে। আমরা সবসময় বলি, পরিবারকে মানসিক সাপোর্ট দিতে হবে, বুঝতে হবে।

আমরা অনেক সময়েই দেখেছি, পারিবারিক সাপোর্ট পেলে, সকলকে সঙ্গে পেলে অনেক সময়েই মহিলারা অনেক সহজে গর্ভধারণ করেন কোনও সমস্যা ছাড়া। তাঁদের গর্ভাবস্থাও অনেক সুস্থ ও সুন্দর হয়ে ওঠে। ফলে কোনওরকম সমস্যা হলেই সেটা পরস্পরকে খেয়াল রাখতে হবে, বুঝতে হবে। দোষারোপ বা অসহিষ্ণুতা দিয়ে বন্ধ্যত্বের সঙ্গে লড়াই করা যায় না।

Infertility in women: Know the causes, symptoms, diagnosis and ...

দ্য ওয়াল: বন্ধ্যত্বের কারণ হিসেবে মেয়েদের ঠিক কী কী সমস্যা দায়ী?

ডক্টর: বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা দেখি, পলিসিস্টিক ওভারি সমস্যা তৈরি করে বন্ধ্যত্বের। এছাড়াও আছে এন্ডোমেট্রিওসিস। এই দুটো খুব বড় কারণ হয়ে ওঠে। ফ্যালপিয়ান টিউবে ব্লকেজও দেখা যায়। এই ব্লকেজ নানা ইফেকশন থেকে হতে পারে। এদেশে জেনিটাল টিউবারকিউলোসিস হয় বহু হবু মায়ের। এটাও বন্ধ্যত্বের একটা কারণ।

দ্য ওয়াল: ছেলেদের কোন কোন সমস্যা বন্ধ্যত্বের কারণ?

ডক্টর: ছেলেদের প্রাথমিক প্যারামিটার, তাদের বীর্য। সেটাই আগে পরীক্ষা করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১০ সালে একটা প্যারামিটার ঠিক করে দিয়েছে, ছেলেদের স্পার্মে কতটা সমস্যা থাকলে সেটা বন্ধ্যত্বের কারণ। এই সমস্যার একটা বড় উপসর্গ হল, বীর্যে শুক্রাণুর উপস্থিতি প্রায় থাকেই না। এদের আমরা বলি অ্যাজুস্পার্মিয়া। এর জন্য বিশেষ চিকিৎসা প্রয়োজন।

What causes infertility? - Apollo Cradle

দ্য ওয়াল: অনেক সময়ে দেখা যায় স্বামী-স্ত্রী দু’জনেরই কোনও শারীরিক সমস্যা নেই, তবু গর্ভধারণ হচ্ছে না। এমনটা কেন হয়?

ডক্টর: এটা প্রায়ই দেখা যায়, ছেলেটির ও মেয়েটির সমস্ত শারীরিক প্যারামিটার নর্মাল থাকার পরেও বাচ্চা আসছে না। এক্ষেত্রে হতে পারে, আরও গভীর ও সূক্ষ্ম কোনও সমস্যা রয়েছে। মাইক্রোমলিকিউলার স্তরে সমস্যা থাকে অনেক সময়ে। যা গভীর অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে। তবে প্রায়ই দেখা যায়, স্ট্রেস একটা বড় ফ্যাক্টর। এখনকার লাইফস্টাইলে যে সব দম্পতির দু’জনেই চাকরি করেন, তাঁদের মধ্যে হ্যাপি টাইম বার করাই কঠিন। তার উপরে চেপে বসে আরও হাজার সামাজিক প্রশ্ন, বাধা। সেক্ষেত্রে গর্ভধারণে সমস্যা হয়।

শুনুন, কী বলছেন চিকিৎসকরা।

দ্য ওয়াল: বন্ধ্যত্বের চিকিৎসার পদ্ধতিগুলো কী কী?

ডক্টর: একটা কথা প্রথমেই বলি, বন্ধ্যত্বের চিকিৎসা মানেই টেস্টটিউব বেবি বা ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশন নয়। যদি বড় স্কেলে দেখি, তবে প্রথমেই আসে ওভ্যুলেশন ইনডাকশন। আমরা ওষুধ দিয়ে বা ইঞ্জেকশন দিয়ে মহিলাদের ওভ্যুলেশন করাই। পলিসিস্টিক ওভারির ক্ষেত্রে এই চিকিৎসা বেশ কার্যকর হয়। ওভ্যুলেশন যখন হয়, সেই ফার্টিলাইজেশন উইন্ডোটা ঠিক করে সেই সময়ে ইন্টারকোর্সের কথা বলি আমরা। এটা কার্যকর পদ্ধতি।

Ayurvedic Treatment For Infertility at Rs 3200/per package ...

দ্বিতীয়ত, কারও ফ্যালপিয়ান টিউবে ব্লক থাকলে আমরা সার্জারি করে টিউব ওপেন করি। ব্লক মানেই কিন্তু টেস্টটিউব বেবি ছাড়া বাচ্চা হবে না, তা নয়। ব্লক খোলার সার্জারি এখন বেশ কার্যকর। একে বলে টিউবোপ্লাস্টি।

তৃতীয় বিকল্প হল, ইনট্রা ইউটেরাইন ইনসেপিনেশন। আমরা হাজবেন্ডের বা ডোনারের স্পার্ম সংগ্রহ করে মহিলার ওভ্যুলেশনের সময়ে স্পার্মটা ওভারিতে পাঠাই।

শেষতম বিকল্প হল আর্টিফিসিয়াল রিপ্রোডাকটিভ টেকনিক। এর আওতায় পড়ে ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশন। এটা শেষতম এবং বিশেষতম পরিস্থিতি।

Infertility treatment & Sterility - Medexical Infertility ...

দ্য ওয়াল: আইভিএফ কাদের ক্ষেত্রে জরুরি?

ডক্টর: কারও যদি পিসিওডি বা এন্ডোমেট্রিওসিসের সমস্যা ওষুধে কাজ না করে, কারও ফ্যালপিয়ান টিউবের ব্লকেজ যদি অস্ত্রোপচার করেও খোলা সম্ভব না হয়, সেক্ষেত্রে আমরা আইভিএফের প্রস্তাব দিই। ছেলেদের ক্ষেত্রে যদি কোনও ভাবেই স্পার্ম কাউন্ট বাড়ানো না যায়, সে ক্ষেত্রেও এটাই করতে হয়।

দ্য ওয়াল: আইভিএফ পদ্ধতিটা ঠিক কী রকম?

ডক্টর: আইভিএফ শুরু করতে হলে আমরা মহিলাদের কিছু টেস্ট করে রাখি আগে। সেগুলো সব নর্মাল হলে, মেনস্ট্রুয়াল সাইকেলের দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনে ডেকে চিকিৎসা শুরু করি। গোনাডোট্রপিন ইঞ্জেকশন দিয়ে স্টিমুলেশন শুরু করি আমরা। এর পরে ইউএসজির মাধ্যমে মনিটর করতে থাকি, ফলিকলগুলো কতটা বড় হচ্ছে। এর পরে আমরা একটা ছোট্ট অস্ত্রোপচার করে ওভারি থেকে ফলিকল বার করে আনি। তার পরে সেটি ল্যাবরেটরিতে স্পার্মের সঙ্গে মেশানো হয়। সেখানেই তৈরি হয় ভ্রূণ। পুরো পদ্ধতি ১৬-১৭ দিন লাগতে পারে।

দ্য ওয়াল: আইভিএফ কি পুরোপুরি নিরাপদ? সফল হওয়ার সম্ভাবনা কতটা?

ডক্টর: আইভিএফ পদ্ধতি পুরোপুরি সেফ। ঝুঁকির সম্ভাবনা ১ শতাংশেরও কম। সব নিয়ম মেনে এই পদ্ধতি কার্যকর করা হলে, পেশেন্টরা সহযোগিতা করলে, সমস্যা প্রায় হয় না বললেই চলে। সাফল্যের রেট ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ।

What is the difference between Test Tube Baby and Surrogacy?

দ্য ওয়াল: আইভিএফ কি খুব খরচসাপেক্ষ?

ডক্টর: দেশে সরকারি ভাবে এই চিকিৎসা প্রায় হয়ই না। ফলে বেসরকারি ভাবে এই চিকিৎসার খরচ অবশ্যই বেশি। কিন্তু আমরা চেষ্টা করছি খরচটা যতটা সম্ভব সাধারণ মানুষের নাগালে নিয়ে আসার চেষ্টা করি। কারও আর্থিক সমস্যা থাকলে সেক্ষেত্রেও আমরা সাহায্য করার বা পাশে থাকার চেষ্টা করি।

যোগাযোগ
ক্রেডেল ফার্টিলিটি সেন্টার
৪৯৬/১ ডায়মন্ড পার্ক, জোকা, কলকাতা ১০৪
ফোন নম্বর: ৯৭৩২৯৪০৫৫৩
ই-মেল: [email protected]