
পিসিওএস, ফ্যালপিয়ান টিউবে জট, এন্ডোমেট্রিওসিস: বন্ধ্যত্বে সমস্যা যখন মেয়েদের
মেয়েদের জননতন্ত্রের নানা সমস্যা ইদানীং কালে যেন ঘরে ঘরে বাড়ছে। এর ফলে শারীরিক অসুস্থতা তো বটেই, সেই সঙ্গে বড় সমস্যা হয়ে উঠছে বন্ধ্যত্ব? বহু দম্পতি ভুগছেন গর্ভধারণ না করতে পারার সমস্যায়। অথচ একটু সুস্থ জীবনযাপন, নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, ও এক্সারসাইজের অভ্যেস কিন্তু মেয়েদের অনেক ক্ষেত্রেই সুস্থতা এনে দিতে পারে। বন্ধ্যত্বের ক্ষেত্রে মেয়েদের ঠিক কোন কোন সমস্যা বড় বাধা হয়ে হয়ে ওঠে? এই বিষয় নিয়ে দ্য ওয়ালের প্রতিনিধি তিয়াষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনায় রয়েছেন ক্রেডেল ফার্টিলিটি সেন্টারের স্ত্রীরোগ ও বন্ধ্যত্ব বিশেষজ্ঞ ডক্টর এস এম রহমান এবং ডক্টর হানি কুরেশি।
দ্য ওয়াল: মেয়েদের ঠিক কী কী সমস্যার কারণে বন্ধ্যত্ব হয়?
ডক্টর: মেয়েদের শরীরে অনেক রকম সমস্যা বা ত্রুটির কারণেই বন্ধ্যত্ব হতে পারে। এগুলিকে আমরা ফিমেল ফ্যাক্টর বলি। এগুলির মধ্যে অন্তত তিনটে ফ্যাক্টর খুব গুরুত্বপূর্ণ। মূলত তিন রকম সমস্যা খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম বা পিসিওস, টিউবাল ফ্যাক্টর অর্থাৎ ফ্যালপিয়ান টিউবে সমস্যা এবং এন্ডোমেট্রিওসিস।
দ্য ওয়াল: পিসিওএস বলতে ঠিক কী বোঝায়?
ডক্টর হানি কুরেশি: পিসিওএস মানে ওভারির সিস্ট হলেও, ওভারিতে সিস্ট আছে মানেই এই সিন্ড্রোম নয়। পিসিওস আসলে একটি হরমোনাল ডিসব্যালেন্স। এই সিন্ড্রোমের কারণ হল, শরীরে ফিমেল রিপ্রোডাক্টিভ হরমোনের পরিমাণ কমে যায়, মেল হরমোন বেড়ে যায়। এর ফলে মেয়েদের মাসিক চক্রে বা মেনস্ট্রুয়েশন সাইকেলে গন্ডগোল দেখা যায়, শরীরে স্থূলতা আসে, ব্রণ বেরোয়, মুখে অবাঞ্ছিত লোম গজায়। এই সমস্যাগুলিকেই সামগ্রিক ভাবে বলা হয় পিসিওএস।
দ্য ওয়াল: পিসিওস-এর সমস্যা ঠিক কী কী হয়? এটা কি শুধুই সিস্ট?
ডক্টর হানি কুরেশি: হরমোন ক্ষরণের ভারসাম্যহীনতার কারণে সর্বপ্রথম মেনস্ট্রুয়েশন সাইকেলে গন্ডগোল দেখা যায়। পাশাপাশি শরীরে স্থূলতা আসে, মুখে ব্রণ ও অবাঞ্ছিত লোম গজায়। পিসিওএস থেকে বন্ধ্যত্ব পর্যন্ত হতে পারে।
দ্য ওয়াল: পিসিওএস হলে দীর্ঘকালীন সমস্যা হতে পারে কি?
ডক্টর হানি কুরেশি: অবশ্যই হতে পারে। পিসিওএস-এর ক্ষেত্রে পরবর্তী কালে অনেক ক্ষেত্রেই মেটাবলিক সমস্যা দেখা যায়। খাবার হজম হওয়ার পদ্ধতি বিগড়ে যায়। হৃদরোগের সমস্যাও দেখা দিতে পারে। ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা থাকে এর ফলে। এন্ডোমেট্রিওসিস ক্যানসার পর্যন্ত ঘটতে পারে।
দ্য ওয়াল: পিসিওএস হয়েছে কিনা কী করে বোঝা যাবে?
ডক্টর হানি কুরেশি: পিসিওএস ডায়াগনসিস করতে গেলে আমরা তিনটি নির্দিষ্টি উপসর্গের উপর নির্ভর করি। এই তিনটির মধ্যে কারও যদি দুটি উপসর্গ দেখা যায়, তাহলে তার পিসিওএস হয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে। এই তিনটি উপসর্গ হল, প্রথমত: মেনস্ট্রুয়েশন সাইকেল নিয়মিত হবে না। দেরি হতে থাকবে প্রতিটি চক্রের আগে। দ্বিতীয়ত: মুখে ব্রণ বা অবাঞ্ছিত রোমের সমস্যা দেখা যাচ্ছে কিনা, সেটা দেখতে হবে। তৃতীয়ত: পেটের আলট্রাসোনোগ্রাফি করলে দেখা যাবে, ওভারির আয়তন বেড়ে গেছে এবং ছোট ছোট সিস্ট দেখা যাচ্ছে। এই তিন রকম উপসর্গের মধ্যে অন্তত দুটি যদি দেখা যায় কারও ক্ষেত্রে, তবে তাঁকে পিসিওএস-এ আখ্রান্ত বলে চিহ্নিত করা হয়।
দ্য ওয়াল: এই সিন্ড্রোমের চিকিৎসা কীভাবে করা হয়?
ডক্টর হানি কুরেশি: কারও যদি পিসিওএস ধরা পড়ে, তাহলে তার চিকিৎসা নির্ভর করে, রোগী কী চাইছেন তার ওপর। পিসিওএস থাকা অবস্থায় কেউ যদি বন্ধ্যত্বের সমস্যা নিয়ে আসেন ও প্রতিকার চান, তবে তার চিকিৎসা আলাদা। সে কথায় পরে আসব। কিন্তু যদি কমবয়সি, কিশোরী বা তরুণী মেয়েরা এই সমস্যা নিয়ে আসে, তাহলে আমরা সবার আগে তাদের লাইফস্টাইল ম্যানেজমেন্ট করতে বলি। ডায়েট, এক্সারসাইজের ওপর জোর দিই, ওজন কমাতে বলি। সেই সঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে আমরা নন-হরমোনাল ওষুধ দিই। এতেও যদি ওজন না কমে ও মাসিক চক্র নিয়মিত না হয়, তাহলে হরমোনাল ওষুধ দিই। এর ফলে সাইকেল নিয়মিত হয়, ওজন কমে, মুখের ব্রণ ও রোম কম হয়।
দ্য ওয়াল: কমবয়সি মেয়েদের পিসিওএস এড়াতে লাইফস্টাইলে কীরকম বদল আনতে হবে?
ডক্টর হানি কুরেশি: এই প্রজন্মের সমস্যা হল, তারা দিনের অনেকটা সময় কম্পিউটার বা মোবাইলে মুখ গুঁজে রয়েছে। শারীরিক পরিশ্রম, খেলাধুলো বেশ কম। এই অভ্যেস সবার আগে ত্যাগ করতে হবে। নিয়মিত ২০-৩০ মিনিট এক্সারসাইজ করতে হবে খেলার সুযোগ না থাকলে। দ্রুত হাঁটতে হবে, যোগব্যায়াম করতে হবে। তাহলে পিসিওএস-এর সমস্যা কম হতে পারে।
দ্য ওয়াল: পিসিওএস-এর কারণে বন্ধ্যত্বের সমস্যা হলে তাঁরা কী করবেন?
ডক্টর হানি কুরেশি: পিসিওস-এর কারণে যাঁরা গর্ভধারণ করতে পারছেন না, তাঁদের আমরা কিছু হরমোনাল পিল দিই, যাতে নিয়মিত ওভ্যুলেশন হয়। ওভ্যুলেশনের সময় মেপে, নির্দিষ্ট সময় অর্থাৎ ফার্টিলিটি উইন্ডো চিহ্নিত করে, কোনও রকম সুরক্ষা না নিয়ে যৌন সম্পর্ক করার কথা বলি পার্টনারের সঙ্গে। এতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উপকার পাওয়া যায়। এর পরেও যদি না হয়, তাহলে কৃত্রিম পদ্ধতিতে গর্ভধারণ করাতে হয়।
দ্য ওয়াল: পিসিওএস এড়ানো যায় কীভাবে?
ডক্টর হানি কুরেশি: লাইফস্টাইল এবং হেলদি লাইফস্টাইল। এছাড়া কোনও উপায় নেই। আমাদের পশ্চিমি খাদ্যাভ্যাস ক্ষতি করছে ওভারির। জাঙ্ক ফুড, মিষ্টি, চিপস—এসব খাবার খাওয়া কমাতে হবে। শাকসব্জি, রঙিন ফলমূল খাওয়া জরুরি। খাবারে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ কমিয়ে প্রোটিন সমৃদ্ধ ডায়েট মেনে চলতে হবে। পাশাপাশি এক্সারসাইজ খুব জরুরি। এগুলো করলে ওভারি সুস্থ থাকবে, সমস্যা কম হবে।
দ্য ওয়াল: টিউবাল ফ্যাক্টর কী? বোঝা যাবে কী ভাবে?
ডক্টর এস এম রহমান: টিউবাল সমস্যা বোঝার জন্য আমরা কিছু পরীক্ষা করি, যাতে দেখা যায় ফ্যালপিয়ান টিউব ওপেন আছে কিনা। এই টেস্টগুলোর নাম হল, এইচএসজি বা হিস্টেরোস্যালপিনগোগ্রাফি, এসআইএস বা স্যালাইন ইনফিউশন সোনোগ্রাফি অথবা ডায়াগনস্টিক ল্যাপ্রোস্কোপি। এর মাধ্যমে আমরা বুঝে যায়, টিউব খোলা আছে না ব্লক আছে। ওপেন থাকলে তো কোনও সমস্যা নেই।
দেখুন, কী বলছেন চিকিৎসকরা।
দ্য ওয়াল: ফ্যালপিয়ান টিউব ব্লক থাকলে তার চিকিৎসা কী?
ডক্টর এস এম রহমান: ল্যাপ্রোস্কপি বা মাইক্রোসার্জারি করা যায়, হিস্টেরোস্কোপিও করা যায়। এর ফলে ফ্যালপিয়ান টিউবের ব্লকেজ খোলা যায়। তবে এই সার্জারিতে সম্ভব না হলে, হিস্টেরোস্কোপিক ক্যানুলেশন বলে একটা সার্জারি করা হয়। এর মাধ্যমে আমরা পেশেন্টের টিউবের ব্লক কউলে দিতে পারি। আমরা দেখেছি, এই সার্জারির পরে ফ্যালপিয়ান টিউব নর্মাল হলে, ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে গর্ভধারণ সফল হয়।
দ্য ওয়াল: আইভিএফ কখন জরুরি?
ডক্টর এস এম রহমান: কিছু ক্ষেত্রে, পিসিওএস বা টিউবাল ফ্যাক্টর ছাড়াও যদি অন্য সমস্যা থাকে, যেমন ফিমেলের ওভারি যদি কার্যকর না থাকে, বা ফিমেলের বয়স ৩৫ পেরিয়ে যায়, বা মেল পার্টনারের কোনও সমস্যা থাকে, তাহলে নানা রকম অস্ত্রোপচারের ঝুঁকি না নিয়ে আমি টেস্টটিউব বেবির জন্য বলব।
দ্য ওয়াল: এন্ডোমেট্রিওসিস বা চকলেট সিস্ট কী, এর উপসর্গ কী?
ডক্টর এস এম রহমান: প্রথমত রোগীরা আসেন কিছু উপসর্গ নিয়ে। মূল উপসর্গ হল, পিরিয়ডের সময়ে ভীষণ পেটে ব্যথা এবং শারীরিক সম্পর্ক গড়ার সময়ে ভীষণ পেটে ব্যথা। আরও একটা বিষয় থাকে, নিয়মিত সম্পর্কে থেকেও গর্ভধারণ সম্ভব হচ্ছে না। এক্ষেত্রে আমরা ট্রান্সভ্যাজাইনাল সোনোগ্রাফি বা টিভিএস অথবা ল্যাপ্রোস্কোপির মাধ্যমে রোগ ডায়াগনসিস করি।
দ্য ওয়াল: এন্ডোমেট্রিওসিস ধরা পড়লে চিকিৎসা কী হবে?
ডক্টর এস এম রহমান: মনে রাখতে হবে, এন্ডোমেট্রিওসিস এবং বন্ধ্যত্ব এই দুই সমস্যা কারও থাকলে, সার্জিক্যাল ট্রিটমেন্টই একমাত্র রাস্তা। সেই সার্জারি করা হয় ল্যাপরোস্কোপির মাধ্যমে। এর মাধ্যমে সিস্টগুলো রিমুভ করা হয়। প্রাথমিক ভাবে এটাই আমরা করি। এর পরে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ শতাংশ রোগী সুস্থ হয়ে যান এবং গর্ভধারণও করেন। কিন্তু যাঁদের ক্ষেত্রে এমনটা হল না, অস্ত্রোপচারে কাজ হল না, বা সিস্ট আবার ফিরে এল, তাঁদের ক্ষেত্রে আইভিএফ পদ্ধতি খুব কার্যকর। ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। এন্ডোমেট্রিওসিস থাকলেও মা হওয়া অসম্ভব নয়।