ভ্যাকসিন নেওয়া বারণ, করোনা থেকে বাঁচতে কী কী নিয়ম মানবেন হবু ও সদ্য মায়েরা

দ্য ওয়াল ব্যুরো: করোনার ভ্যাকসিন দেওয়া হবে না গর্ভবতী মায়েদের। যে মায়েরা সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন, তাঁরাও টিকাকরণের বাইরেই থাকবেন। তাহলে করোনা থেকে মুক্তির উপায় কী? হবু মায়েদের মনে এই প্রশ্নটাই কাঁটার মতো খচখচ করছে। সদ্য সন্তানের জন্ম দিয়েছেন যে মায়েরা তাঁদের ভয় আরও বেশি। সদ্যোজাতের শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়াবে না তো? অথবা বুকের দুধ কতটা সুরক্ষিত এই সময়? হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যাওয়ার আগেও এই ভয়টা থেকেই যাচ্ছে।

এইসব প্রশ্নেরই সহজ উত্তর দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। করোনা কালে অন্তঃসত্ত্বারা কীভাবে সুরক্ষিত থাকবেন, ব্রেস্ট ফিডিং করাচ্ছেন যে মায়েরা তাঁদের কী কী নিয়ম মেনে চলতে হবে, সে বিষয়ে কিছু স্ট্র্যাটেজির কথা জানিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক। হবু মা ও সদ্য মায়েদের করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য একটা গাইডলাইনও সামনে আনা হয়েছে।

দেখে নেওয়া যাক, কীভাবে নিরাপদে সংক্রমণ এড়িয়ে চলতে পারবেন মায়েরা। কিভাবেই বা সুরক্ষিত রাখবেন সদ্যোজাতদের।

Image result for How to Protect Lactating Mothers and Newborns Who Cannot Access Covid-19 Vaccine

অন্দরবাসেই কি সুরক্ষিত হবু ও সদ্য মায়েরা? কী বলছে ‘কোকুনিং স্ট্র্যাটেজি’

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা কালে অন্তঃসত্ত্বা ও সদ্য মায়েদের জন্য কোকুনিং স্ট্র্যাটেজির কোনও বিকল্প নেই। আমেরিকার বিজ্ঞানীরাও একই কথা বলেছেন। এখন প্রশ্ন হল, এই স্ট্র্যাটেজি ঠিক কী?

কোকুনিং-এর অনেকগুলো দিক আছে। প্রথমত, কোকুনিং-এর অর্থ হল কোনও সম্ভাব্য বিপদ এড়াতে অন্দরবাসে থাকে। মূলত কোনও রোগ বা সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচতে নিরাপদে বাড়িতে থাকার কথা বলেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্যমন্ত্রকের গাইডলাইনেও হবু মা বা সদ্য মায়েদের অন্দরবাসে থাকার ওপরেই জোর দেওয়া হয়েছে। বেশি মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে, ছোঁয়া বাঁচিয়ে থাকাই এই সময় নিরাপদ। ডাক্তারের ক্লিনিকে যাওয়ার পরিবর্তে ফোনে সমস্যার কথা জানালে বেশি ভাল হয়। প্রয়োজনে টেলিমেডিসিনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত, মায়েদের ইমিউনাইজেশন সবচেয়ে বড় ব্যাপার। কোকুনিং স্ট্র্যাটেজি বলে, হবু মায়েরা পরিবারের যাঁদের সঙ্গে মেলামেশা করছেন বা তাঁদের কাছাকাছি যাচ্ছেন যাঁরা তাঁদের ভ্যাকসিন নিয়ে রাখা জরুরি। আত্মীয় স্বজন, আয়া থেকে পরিবারের ঘনিষ্ঠ লোকজনেরা যদি টিকা নিয়ে রাখের তাহলে রোগ ছড়াবার সম্ভাবনা কমে।

Image result for pregnancy covid care

করোনার টিকা এই মুহূর্তে নিতে পারবেন না প্রসূতিরা। কারণ গর্ভাবস্থায় টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কেমন হবে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছেন না গবেষকরাও। তাই আপাতত করোনার টিকা পাবেন না গর্ভবতীরা। কিন্তু টিটেনাস-ডিপথেরিয়া ও হুপিং কফের ভ্যাকসিন নিতেই পারেন গর্ভবতী মায়েরা। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জন্মের প্রথম ছয় সপ্তাহের পর থেকে টিকা দেওয়া শুরু হয় সদ্যোজাতদের। ওই সময়টা তাই মায়ের শরীরের অ্যান্টিবডিই সুস্থ রাখে শিশুদের। হবু মায়েরা যদি ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে এই তিন ভ্যাকসিনের ডোজ নিয়ে রাখেন, তাহলে জন্মের পর সদ্যোজাতরাও অনেকটাই সুরক্ষিত থাকতে পারে।

গর্ভাবস্থায় করোনার প্রভাব কী হতে পারে?

মায়ের শরীর থেকে প্যাথোজেনের সংক্রমণ শিশুর শরীরে ছড়াতে পারে নানা ভাবে। প্লাসেন্টার মাধ্যমে অথবা প্রসবের সময় বিভিন্ন কারণে। ডাক্তাররা একে ‘ভার্টিকল ট্রান্সমিশন’ বলেন। এইচআইভি ও জিকা ভাইরাসের ভার্টিকল ট্রান্সমিশন সম্ভব। কিন্তু সার্স-কভ-২ ভাইরাস এইভাবে ছড়াতে পারে কিনা সেটা এখনও সঠিকভাবে বলতে পারেননি গবেষক-চিকিৎসকরা। তবে গর্ভাবস্থায় করোনা ছড়ালে তার নানারকম প্রভাব পড়তে পারে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা সংক্রমণ বেশি ছড়িয়ে গেলে গর্ভপাত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। গর্ভস্থ ভ্রূণের নড়াচড়া কমে যেতে পারে, মায়ের শ্বাসকষ্ট বা অন্যান্য শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। সেই সঙ্গে প্রবল মানসিক চাপ, হতাশা গ্রাস করতে পারে।

Image result for pregnancy covid care

কী কী নিয়ম মানতে হবে হবু মায়েদের?

গর্ভাবস্থায় হাইজিন মেনে চলা খুবই জরুরি। বারে বারে হাত ধোওয়া, খাবার আগে ভাল করে সাবান দিয়ে হাত ধোওয়া জরুরি। জামাকাপড় প্রতিদিন পরিষ্কার করতে হবে। বিছানা, চাদর সাফসুতরো রাখা জরুরি।

এই সময় অ্যাকসেসরিজের ব্যবহার যত কম করবেন ততটাই ভাল। এগুলো থেকেও সংক্রমণ ছড়াবার ঝুঁকি থাকে।

গর্ভাবস্থায় কিছু রুটিন টেস্ট দরকার। আলট্রাসোনোগ্রাফির সঙ্গে অন্যান্য টেস্টের ব্যাপারে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

শুনে নিন স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ ডক্টর মানস কুণ্ডু এবং শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডক্টর শান্তনু রায়ের পরামর্শ।

সর্দি-কাশি হলে হেলাফেলা একদম নয়। প্রয়োজনে স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

অযথা দুশ্চিন্তা, চিন্তাভাবনা দূরে রাখতে হবে। রাতে ৮ ঘণ্টা টানা ঘুম জরুরি। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মন হাল্কা রাখতে বই পড়া ভাল, বাড়ির হাল্কা কাজ, রান্নাবান্নাও মানসিক চাপ থেকে দূরে রাখে।

গর্ভাবস্থায় নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করানো জরুরি, ইউএসজি স্ক্যান আর কিছু রক্তপরীক্ষা করে নিতে তো হবেই। করোনার লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।

Image result for pregnancy care food

বুকের দুধে করোনা ছড়ায় না

সদ্য মায়ের শরীরে যদি করোনা সংক্রমণ থেকে থাকে, তাহলেও ব্রেস্ট ফিড করানো যায়। ডাক্তাররা বলছেন, মায়ের বুকের দুধে ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়ায় না। বরং মায়ের প্রথম হলুদ দুধ শিশুর জন্য সঞ্জীবনী হিসেবে কাজ করে। জন্মের পরে শিশুর আদর্শ খাদ্য হল কোলোস্ট্রাম। এই কোলোস্ট্রামই হল সেই হলুদ দুধ যা শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে নিঃসৃত হয়। প্রোটিন, ভিটামিন-এ ও সোডিয়াম ক্লোরাইড সমৃদ্ধ অত্যন্ত পুষ্টিগুণ সম্পন্ন এই দুধ সামান্য খেলেই শিশুর পেট ভরে যায়। এই হলদেটে দুধ গ্রোথ ফ্যাক্টর ও অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ফ্যাক্টর সমৃদ্ধ হওয়ায় শিশুর ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে।

ডাক্তাররা বলেন,  মাতৃদুগ্ধের সঙ্গে কৃত্রিম ফর্মুলা দুধের একটা বিশেষ পার্থক্য আছে। মায়ের দুধের উপাদান শিশুর দরকার অনুযায়ী অনবরত বদলে যায়। সদ্যোজাতদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের চাহিদা অনুযায়ী মাতৃদুগ্ধের উপাদানও বদলাতে থাকে। ব্রেস্ট মিল্কে ডেকোসাহেক্সানোয়িক অ্যাসিড নামে একটি বিশেষ ধরনের উপাদান থাকে, যা শিশুর বুদ্ধির বিকাশে অত্যন্ত উপযোগী। তাই ডাক্তারবাবুরা বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে বুকের দুধ খাওয়ালে কোনও সমস্যা নেই।

যে মায়েরা শারীরিকভাবে দুর্বল বা বুকের দুধ খাওয়াতে সক্ষম নন, তাঁরা মিল্ক ব্যাঙ্কের দ্বারস্থ হতে পারেন। তবে মিল্ক ব্যাঙ্কে পাস্তুরাইজড এই দুধ সব সুরক্ষা বিধি মেনেই সংরক্ষণ করে রাখা হয়। দুধ কেনার সময়ও হাইজিনের ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে অবশ্যই।

Image result for lactating mother

মন ভাল রাখুন হবু মায়েরা

শরীর চাঙ্গা রাখার সঙ্গে সঙ্গে মন ভাল রাখাটাও খুব জরুরি। বিশেষ করে গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস সবরকম নিয়ম মেনে চলতেই হবে। এই করোনা কালে দীর্ঘদিন অন্দরবাসে থেকে এমনিতেই শরীর-মন বিপর্যস্ত অনেকের। মানসিক চাপও বেড়েছে। তাই হবু মায়েদের বেশি সতর্ক থাকা জরুরি। বেশি চিন্তা, সংক্রমণ ছড়ানোর ভয়, অযথা আতঙ্ক থেকে রক্তচাপ বাড়তে পারে, গর্ভপাত হওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায়।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গর্ভবতীদের মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখতে হবে পরিবারের লোকজনদেরই। কোনওরকম উত্তেজনা যাতে তৈরি না হয় সেদিকে বিশেষ করে নজর দিতে হবে। বিশেষত করোনা সংক্রমণজনিত কোনও খবর, আতঙ্ক না ছড়ানোই ভাল। পুষ্টিকর খাবার খাওয়া এই সময় জরুরি।  প্রয়োজনীয় ওষুধ, যেমন ফোলিক অ্যাসিড ও অন্য ওষুধ খেতে ভুললে চলবে না। আর সাধারণ স্বাস্থ্যবিধিও মেনে চলতে হবে।