মুখের ব্যাকটেরিয়া থেকে হতে পারে ফুসফুসের ক্যানসার! ইমিউনোথেরাপিতে পথ দেখাচ্ছেন ডাক্তাররা

ভারতে ন্যাশনাল ক্যানসার রেজিস্ট্রি প্রোগ্রামের তথ্য বলছে, এ বছরই প্রায় ৬ লাখ ৭৯ হাজারের বেশি পুরুষের শরীরে ক্যানসার ধরা পড়েছে, মহিলাদের সংখ্যাটা আরও বেশি ৭ লাখ ১২ হাজারের কাছাকাছি।

দ্য ওয়াল ব্যুরো: করোনা কালে ফুসফুসের সংক্রমণ সবচেয়ে বড় চিন্তার কারণ। ভাইরাসের সংক্রমণে জটিল শ্বাসযন্ত্রের রোগ বা সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটারি সিন্ড্রোম নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। তবে এ সবকিছুর মাঝেই চুপিসাড়ে হানা দিচ্ছে আরও এক মারণ রোগ। ফুসফুসের ক্যানসার। বিশ্ব জুড়ে প্রতি বছর এই মারণ রোগে মৃত্যু হয় ১৩ লাখের বেশি। এই সংখ্যাটা ক্রমেই বাড়ছে। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, আগামী বছরগুলিতে ফুসফুসের ক্যানসারের প্রকোপ বাড়বে। যার একটা বড় কারণ হবে ধূমপান, পরিবেষ দূষণ এবং অনিয়ন্ত্রিত ডায়েট ও অসংযমী যাপন অভ্যাসের জন্য সংক্রামক জীবাণুদের বাড়বাড়ন্ত।

ভারতে ন্যাশনাল ক্যানসার রেজিস্ট্রি প্রোগ্রামের তথ্য বলছে, এ বছরই প্রায় ৬ লাখ ৭৯ হাজারের বেশি পুরুষের শরীরে ক্যানসার ধরা পড়েছে, মহিলাদের সংখ্যাটা আরও বেশি ৭ লাখ ১২ হাজারের কাছাকাছি। এর মধ্যে ৬৮ শতাংশ পুরুষ ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতে প্রতি ৯ জনের মধ্যে একজন ক্যানসারে আক্রান্ত হন। একুশ, বাইশ সালে এই সংখ্যা আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। যার মধ্যে রক্তের ক্যানসার, ফুসফুস, প্রস্টেট, ব্রেস্ট ক্যানসারের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

ফুসফুসের ক্যানসারের জন্য ৮৫ শতাংশ দায়ী করা হয় তামাক বা তামাকজাত দ্রব্য সেবনকে। বাকি ১০-১৫ শতাংশ নন-স্মোকার বা প্যাসিভ স্মোকিং দায়ী। তবে কারণ আরও আছে, বায়ু দূষণ, জেনেটিক ফ্যাক্টর, পরিবারের ক্যানসারের ইতিহাস থাকলে ইত্যাদি। সম্প্রতি গবেষকরা বলছেন, ফুসফুসের ক্যানসারের আরও একটা বড় কারণ মাইক্রোবিয়াম বা মাইক্রোবস। যার মধ্যে ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস, ভাইরাস, আর্কিয়া সবই রয়েছে। খাওয়াদাওয়া থেকে বা অপরিচ্ছন্নতা থেকে মুখে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া জন্মায় যার থেকেও ফুসফুসের ক্যানসারের সম্ভাবনা থাকে।

ফুসফুসের ঠিক কোথায় হয় ক্যানসার?

তার আগে জানতে হবে ফুসফুসের ঠিক কোথায় ক্যানসারের বাড়াবড়ন্ত হয়। আমরা জানি, ডান ফুসফুসের তিনটি ভাগ থাকে যাকে লোব বলে, বাম ফুসফুসে থাকে দুটি। শ্বাস নেওয়ার সময় বাতাস মুখ ও নাক দিয়ে ঢুকে শ্বাসনালী পথে ফুসফুসে পৌঁছয়। একে বলে উইন্ডপাইপ বা ট্রাকিয়া। এই ট্রাকিয়া কয়েকটি নালী বা ব্রঙ্কিতে বিভক্ত থাকে। এই ব্রঙ্কি ফুসফুসে ঢুকে আরও ছোট ছোট ব্রঙ্কিতে ভাগ হয়ে যায়। ছোট ব্রঙ্কি গুলো শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে ব্রঙ্কিওলে ভাগ হয় যার শেষভাগে থাকে বায়ুথলি বা অ্যালভিওলাই। এই অ্যালভিওলাইয়ের কাজ হল বিশুদ্ধ অক্সিজেন শরীরে ঢোকানো ও কার্বন-ডাই অক্সাইড ছেঁকে বের করে দেওয়া।

Even Non-Smokers Can Get Lung Cancer | University of Utah Health

ক্যানসার কোষের বাড়বাড়ন্ত হয় মূলত ব্রঙ্কি ও ব্রঙ্কিওলের কোষগুলিতে। কোষের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি হয়ে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে গোটা ফুসফুসেই। শ্বাস-প্রশ্বাসের পথ বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। অক্সিজেন ঢোকা ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড বেরিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াটাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সেই সময় শ্বাসের কষ্ট দেখা দেয়। ঘন ঘন কাশি হতে থাকে। কাশির সঙ্গে রক্ত বেরিয়ে আসে। কফের সঙ্গে বা থুতু-লালার সঙ্গে রক্ত বের হয়। ফুসফুসে যদি কোষের বৃদ্ধি হয়ে টিউমার তৈরি হয় তাহলে বুকে ব্যথা শুরু হয় রোগীর। তীব্র প্রদাহ হতে থাকে। শরীরের গাঁটে গাঁটে ব্যথা শুরু হয়। ওজন কমে যাওয়া, খিদে কম হওয়া ইত্যাদিও ফুসফুসের ক্যানসারের লক্ষণ।

মুখের ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ ছড়ায় ফুসফুসে?

সাংহাই ওম্যান ও মেন হেলথ স্টাডিতে এই তথ্য উঠে এসেছে। ‘থোরাক্স’ সায়েন্স জার্নালে এই গবেষণার রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। তাছাড়া এই নতুন তথ্য নিয়ে গবেষণা চলছে সারা বিশ্বেই। বিজ্ঞানীরা বলছেন, নন-স্মোকারদের ক্যানসারের বড় কারণ এই মাইক্রোবিয়াম। থুতু-লালায় এমন কিছু ফাঙ্গাস বা ব্যাকটেরিয়া জন্মায় যার থেকে সংক্রমণ শ্বাসনালী হয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে ফুসফুসে। ৯০ জন মহিলা ও ২৪ জন পুরুষ যাঁরা ধূমপান করেন না তাঁদের মুখ থেকে নেওয়া নমুনা পরীক্ষা করে এমন দেখা গেছে। সাত বছর ধরে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ জমা হতে হতে ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি হয়েছে ফুসফুসে।

Type of Bacteria and Abundance in Oral Microbiome Linked to Lung Cancer Risk in Nonsmokers

বিজ্ঞানীরা বলছেন ফার্মিকিউটস্ (Firmicutes)নামে এক ধরনের গ্রাম-পজিটিভ ব্যাকটেরিয়া আছে যারা ফুসফুসে ক্যানসারের জন্য দায়ী। ল্যাকটোব্যাসিলাস পর্বের এই ব্যাকটেরিয়া থুতু-লালা থেকে ফুসফুসের কোষে ছড়াতে পারে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ডক্টর ডেভিড ক্রিসটিয়ানি বলছেন, এই ব্যাকটেরিয়া বিভাজিত হয়ে সংখ্যায় বাড়লে কোষে তীব্র প্রদাহ শুরু হয়। অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি হতে থাকে কোষের। খুব দ্রুত ডিএনএ বা জিনের বদল হতে থাকে। ক্যানসার জিনের বৃদ্ধি হয়।

Gram Stian Was Show Gram Positive Bacilli. Stock Photo, Picture And Royalty Free Image. Image 38627314.

মুখের ব্যাকটেরিয়া কী থেকে জন্মায়? এই বিষয়ে এখনও সবিস্তার তথ্য দিতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। তাঁদের অনুমান, পরিবেশ দূষণ এর বড় কারণ। বাতাসে ভাসতে থাকা দূষিত কণা মুখে ঢুকে এই ধরনের মাইক্রোবসের জন্ম দিতে পারে। তাছাড়া খাওয়াদাওয়ার অভ্যাস থেকেও মুখের ব্যাকটেরিয়া জন্মায়। পুষ্টিকর খাবারের অভাব, শরীরে ভিটামিন ও মিনারেলসের অভাব, অধিক মদ্যপান বা নেশার জিনিস খাওয়া, অপরিচ্ছন্নতা, নানা কারণ থাকতে পারে এর পিছনে।

জটিল অস্ত্রোপচার সবসময় নয়, কাজে দেয় ইমিউনোথেরাপিও

ক্যানসার নিরাময়ে অস্ত্রোপচার, রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপির ওপর বেশি ভরসা রাখেন গবেষকরা। তবে ইদানীং উন্নত পদ্ধতিতে ইমিউনোথেরাপিতেও মারণ রোগের মোকাবিলা করা হচ্ছে। ইমিউনোথেরাপি মানেই হল শরীরের ইমিউন কোষকে সক্রিয় করে রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উপযোগী করে তোলা। তার জন্য বাইরে থেকে নানা রকম ইমিউন বুস্টার বা ইনহিবিটর প্রয়োগ করেন ডাক্তাররা। এই ইনহিবিটর শরীরের বি-কোষ ও ঘাতক টি-কোষকে সক্রিয় করে তোলে।

২০১৫ সালে মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ফুসফুসের ক্যানসার চিকিৎসায় ইমিউনোথেরাপিকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। আমাদের দেশে এই থেরাপির প্রয়োগও শুরু হয়েছে। গবেষকরা বলছেন, ফুসফুসের ক্যানসার অনেক রকম হয়, যার মধ্যে ১০-১৫ শতাংস হল স্মল-স্কেল লাং ক্যানসার (SCLC) ও ৮৫-৯০ শতাংশ হল নন-স্মল স্কেল লাং ক্যানসার (NSCLC)। এই দুই রকম ক্যানসারই রুখে দেওয়া সম্ভব ইমিউনোথেরাপি দিয়ে।

সেটা কেমন? গবেষকরা বলছেন, ইজিএফআর টাইরোসিন কাইনেজ ইনহিবিটর ও এএলকে ইনহিবিটর প্রযোগ করলে দীর্ঘমেয়াদী ফল পাওয়া যায়। ইমিউনোথেরাপি ড্রাগ ওষুধের মতো খাওয়ানো যায় রোগীকে। শরীরে গিয়ে টিউমার কোষের সঙ্গে লড়াই করতে পারে। ক্যানসার কোষ নষ্ট করার জন্য কেমো দেওয়ার দরকার পড়ে না। ইমিউনোথেরাপিতে শরীরে ঘাতক টি-কোষ বা সাইটোটক্সিক টি-লিম্ফোসাইট কোষ সক্রিয় হয়ে ওঠে। ঘাতক টি-কোষ ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি থামিয়ে দেয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ক্যানসার চিকিৎসায় ইমিউনোথেরাপির উন্নতি হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে অনেক দ্রুত ও যন্ত্রণাহীনভাবে ক্যানসার রোগের চিকিৎসা সম্ভব।