বাচ্চা খালি বলে হাতে-পায়ে ব্যথা? বাহানা নয়, সমস্যা গভীরে

দ্য ওয়াল ব্যুরো: সন্ধেবেলা পড়তে বসেই রাহুল বলছিল পায়ে ব্যথা করছে। রোজই একই বায়না। কখনও হাতে ব্যথা, তো কখনও পায়ে। সন্ধে হলে ব্যথা বাড়ে, বায়নাও। মা ভেবেছিলেন পড়ায় ফাঁকি দেওয়ার অজুহাত। বাচ্চাদের এ রকম হুটহাট পায়ে ব্যথা হওয়া কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। ৩-১৪ বছরের বাচ্চাদের মধ্যে এই ধরনের ব্যথা দেখা যায়। তাই বাচ্চা পায়ে ব্যথা বললে তাকে অজুহাত ভেবে এড়িয়ে যাবেন না। সমস্যা গভীরও হতে পারে।

ছোটদের এই ধরনের হাতে-পায়ে ব্যথা নাগাড়ে চলতে থাকলে তাকে গ্রোথ পেন বলেন ডাক্তারবাবুরা। অনেক সময় পায়ের হাড়েও সমস্যা দেখা দিতে পারে, সে কারণেও ব্যথা হয়। তাই ব্যথার সঠিক কারণ না জানা অবধি, অবহেলা করা ঠিক হবে না। ব্যথা বাড়াবাড়ি রকম বেশি হলে ডাক্তার দেখানো অবশ্যই উচিৎ।

Growing Pains - Knee And Leg Pain In Children | familydoctor.org

গ্রোথ পেন কী ক্ষতিকর?

বাচ্চাদের বেড়ে ওঠার সময়ে বা গ্রোয়িং স্টেজে এই ধরনের ব্যথা বেশি হয়। বেশি খেলাধূলা করলে বা ছোটাছুটি করলে ব্যথা বাড়ে। সব বাচ্চার গ্রোথ পেন হয় তা কিন্তু নয়, তবে অনেকের ক্ষেত্রে গ্রোথ পেন বেশি হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক বাচ্চারাই ৩ থেকে ১৪ বছর বয়সে এমন গ্রোথ পেন হতে দেখা যায়। একটা নির্দিষ্ট বয়সের পরে ব্যথা চলেও যায়। তবে চিন্তার ব্যাপার হল, যদি হাড়ের গঠনে কোনও সমস্যা থাকে বা হাড়ে টিউমার বাসা বাঁধে তাহলে সমস্যা গুরুতর। তাই গ্রোথ পেনের জন্য ব্যথা, নাকি অন্য রোগের কারণে, সেটা আগে পরীক্ষা করে দেখা দরকার।

The effect of JIA on a child's healthGrowing Leg Pain in Children: Reasons, Symptoms & Home Remnedies

গ্রোথ পেন সাধারণত পায়ের কাফ মাসলেই হয়। তা ছাড়া থাই বা হাঁটুর পিছনের অংশেও শিরায় টান ধরার মতো ব্যথা হতে পারে। এই ধরনের ব্যথা দুই পায়েই হয়। অল্টারনেটলি বা একসঙ্গেও দু’পায়ে হতে পারে। অনেক বাচ্চার পায়ের হাড় বা জয়েন্টের চারপাশে ব্যথা হয়। রাতভর চিনচিনে ব্যথা হতে দেখা যায়। তাই রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে পায়ের ব্যায়াম বা লেগ স্ট্রেচ করার মতো কিছু ব্যায়াম করলে ভাল। এতে পায়ে রক্ত সঞ্চালন ভাল হয়।

 

সমস্যা পায়ের হাড়ে নেই তো?

বাচ্চাদের হাড় হল গ্রোয়িং বোন। অনেক নরম হয়। বেড়ে ওঠার সময় গ্রোয়িং স্টেজে পায়ে ব্যথা হয় অনেকের। তবে একটা বয়সের পরে গ্রোথ পেন চলে যায়। তাছাড়া বাচ্চাদের পায়ের হাড়ে ফ্র্যাকচার হয়, অনেকের হাঁটুর বা পায়ের পাতা বাঁকা হয়। শিশুদের হাড়ের সমস্যা বা পেডিয়াট্রিক অর্থোপেডিকের চিকিৎসা অ্যাডাল্ট অর্থোপেডিকের থেকে একদমই আলাদা। মেডিসিনও অন্যরকম। বাচ্চাদের জ্বর হলে যেমন প্যারাসিটামলের অর্ধেক ডোজ দিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু অর্থোপেডিক সমস্যা হলে বড়দের ওষুধের অর্ধেক দিয়ে চিকিৎসা হয় না। গোটা থেরাপিটাই অন্যরকম।

Growing pains: symptoms, causes, diagnosis, tips, when to see a doctor

বাচ্চাদের হাড়ে ফ্র্যাকচার হলে তার ট্রিটমেন্ট, প্রোটোকল আলাদা। অ্যাডাল্ট ফ্র্যাকচার ও পেডিয়াট্রিক ফ্র্যাকচারের ধরন আলাদা। পায়ের হাড়ে কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে সেটা আগে চিহ্নিত করা দরকার।

 

জুভেনাইল আর্থ্রাইটিস কী না পরীক্ষা করিয়েছেন?

জুভেনাইল ইডিওপ্যাথিক আর্থ্রাইটিস হল এমন এক প্রদাহজনিত রোগ যেখানে ইমিউন কোষই শরীরের শত্রু হয়ে যায়। সোজা কথা হলতে গেলে অটোইনফ্ল্যামেটরি বা অটোইমিউন রোগ। ইমিউন কোষের কাজই হল শরীরের প্রতিরক্ষা করা। কিন্তু কোনওভাবে যদি এই ইমিউন কোষগুলো অতিসক্রিয় হয়ে যায় তাহলে উল্টে কোষেরই ক্ষতি করে ফেলে। তখন সুরক্ষা দেওয়ার বদলে তারাই তীব্র প্রদাহের কারণ হয়ে ওঠে। ক্ষতিকর রাসায়নিক ক্ষরণ করে যা হাড়, অস্থিসন্ধির ক্ষতি করে। জুভেনাইল আর্থ্রাইটিসের ক্ষেত্রে সাইনোভিয়াল তরলের ক্ষরণ বেশি হতে থাকে। আমাদের শরীরের প্রতিটি অস্থিসন্ধি বা জয়েন্টে আছে এই সাইনোভিয়াল ফ্লুইড। এর কাজ হল অস্থিসন্ধির প্রধান উপাদান কার্টিলেজের পুষ্টি যোগানো। এই তরলের ক্ষরণ হলে কার্টিলেজ তরতাজা থাকে, অস্থিসন্ধি পুরোপুরি সচল থাকে। কিন্তু যদি এই তরলের ক্ষরণ বেশি হয় তখনই তা গাঁটে গাঁটে তীব্র প্রদাহ তৈরি করে। যার ফলে সন্ধিতে ব্যথা শুরু হয়। উঠতে, বসতে, হাঁটাচলা করতে সমস্যা হয়। অনেক সময় জয়েন্ট ফুলে যায়, লালভাব দেখা দেয়।

এর অনেকগুলো লক্ষণ আছে—

জয়েন্টের জায়গাগুলোতে র‍্যাশ হতে পারে। জ্বালাপোড়ার মতো ব্যথা হতে পারে।

ঘন ঘন জ্বর আসতে পারে বাচ্চাদের। শরীর দুর্বল হতে থাকবে। স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ শক্তি কমে যাবে।

জয়েন্টগুলোতে ফোলাভাব দেখা দেবে, লাল হয়ে যেতে পারে।

খিদে কমবে, শরীরে অস্বস্তি দেখা দেবে।

অস্থিসন্ধি স্টিফ বা শক্ত হতে থাকবে। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার পরে উঠতে সমস্যা হবে। চলাফেরা করলে ব্যথা হবে। দৌড়োবার সময় হাঁটুতে ব্যথা হতে পারে।

হাত-পায়ের নমনীয় ভাব চলে যাবে। গাঁটে গাঁটে অসহ্য ব্যথা শুরু হবে।

Is It Growing Pains or Something More Serious?

ডাক্তারের কাছে ছোটার আগে ঘরে কী কী করবেন

আগে বাড়িতেই বাচ্চার পায়ের যত্ন নিতে পারেন। ব্যথা ক্রনিক হতে থাকলে তখন ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

গরম জলে সেঁক দিলে সবচেয়ে বেশি আরাম পাবে বাচ্চা। কখনও গরম জলে সামান্য নুন ফেলে দিয়ে বাচ্চাকে হাঁটু অবধি পা ডুবিয়ে থাকতে বলবেন। এতে পায়ের আরাম হবে। জয়েন্টে ব্যথা থাকলেও কিছুটা আরাম পাবে বাচ্চা।

হট প্যাড দিয়েও আরাম পাবে বাচ্চা।

পায়ে হাল্কা করে ম্যাসাজ করে দিলে রক্ত সঞ্চালন ভাল হবে, ব্যথা হবে না।

কখনওই জোরে জোরে হাত-পা টিপবেন না বা ম্যাসাজ করবেন না।

ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নিজে থেকে কোনও ওষুধ খাওয়াবেন না।

 

লাইফস্টাইলে বদল রোগ বশে রাখতে পারে

বাচ্চাদের পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে সবসময়। মাছ, ফল, সবুজ সব্জি, দানাশস্য ডায়েটে রাখতেই হবে। যে কোনও রকম জাঙ্ক ফুড একেবারেই খাওয়া চলবে না। প্যাকেটজাত খাবার, নরম পানীয় নৈব নৈব চ।

হট অ্যান্ড কোল্ড ট্রিটমেন্ট করা হয় অনেক সময়। এতে সন্ধিতে তীব্র প্রদাহ কমে। ব্যথায় অনেক আরাম মেলে।

বাচ্চারা যেন একই ভাবে বসে বা দাঁড়িয়ে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অনেক সময় একই ভঙ্গিতে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলে জয়েন্টের ব্যথা আরও বাড়ে। রাতে পর্যাপ্ত ঘুম দরকার। টানা আট ঘণ্টা ঘুমোতেই হবে বাচ্চাদের। যন্ত্রণা শুরু হলে দৌড়োদৌড়ির বদলে বিশ্রাম নিলে অনেক আরাম পাওয়া যাবে। কিছু যোগা ও প্রাণায়াম করা যেতে পারে, তবে সেটা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে তবেই করা ভাল।

সব পায়ের ব্যথাকেই গ্রোথ পেন ভেবে বসবেন না। তার কারণ অন্য কিছুও হতে পারে। তাই লক্ষণ বুঝে ডাক্তার দেখিয়ে নেওয়া ভাল।