
ফটাফট ফাস্ট ফুড নয়, ভাজাভুজি থাক তফাতে, পেট-কোমরের মেদ কমানোর দাওয়াই বললেন বিশেষজ্ঞ
গাদা গাদা ফ্যাট, মাখন-মেয়োনিজ-চিজ চপচপে খাবার, প্রিজারভেটিভ ও অতিরিক্ত চিনি মেশানো সফট ড্রিঙ্কস থেকেই চড়চড়িয়ে বাড়ছে মেদ। বয়ঃসন্ধিতেই জাঁকিয়ে বসছে স্থূলত্ব বা ওবেসিটি।
সঞ্জীব আচার্য
কর্ণধার সিরাম অ্যানালিসিস
খিদে পেলেই ফাস্ট ফুডে পেট ভরানো আজকাল প্রায় সকলের কাছেই সহজ সমাধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই চটজলদি সমাধানেই ওঁত পেতে রয়েছে বিপদ। গাদা গাদা ফ্যাট, মাখন-মেয়োনিজ-চিজ চপচপে খাবার, প্রিজারভেটিভ ও অতিরিক্ত চিনি মেশানো সফট ড্রিঙ্কস থেকেই চড়চড়িয়ে বাড়ছে মেদ। বয়ঃসন্ধিতেই জাঁকিয়ে বসছে স্থূলত্ব বা ওবেসিটি। জানেন কি, ভারতে ১৪ কোটির বেশি মানুষ ওবেসিটিতে ভুগছেন? স্থূলত্বের রোগে চিনের পরেই ভারতের নাম সবচেয়ে আগে। হাঁটুর ব্যথা থেকে ডায়াবিটিস, হার্ট সুস্থ রাখা থেকে কোমরে ব্যথা, সবেতেই শরীরের বাড়তি ওজনকে বশে এনে রোগের সঙ্গে লড়াই করার চেষ্টা করা হয়। অথচ ওজন কমানোর কোনও চোরাগোপ্তা উপায় নেই। নেই কোনও শর্টকাটও। প্রতি দিন ডায়েট মেনে খাওয়া, ব্যায়াম ও পর্যাপ্ত ঘুমের উপর ভরসা করে ওজন কমানোর পদ্ধতিতে ভরসা করেন চিকিৎসকরা।
করোনা কালে ওজন বাড়ানো মোটেই চলবে না
এই করোনাকালে ওজন বৃদ্ধিও বড় দায়। ফ্রান্সের বিজ্ঞানীরা ওবেসিটির সঙ্গে সংক্রমণ বৃদ্ধির যোগসূত্র পেয়েছিলেন। দাবি করা হয়েছিল, ওবেসিটি করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। ওজন বাড়লে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। রক্তচাপের হেরফের হয়, হার্টের রোগও দেখা দেয়। এই সবকিছুরই ফায়দা নিতে পারে মারণ ভাইরাস। ওবেসিটি থেকে ডায়াবেটিস, রোগ হানা দিচ্ছে বয়ঃসন্ধিতেও। অল্প বয়সেই জমছে পেটে ও কোমরের অবাঞ্ছিত মেদ। ওবেসিটি ক্যানসারেরও রিস্ক ফ্যাক্টর। মুখের ক্যানসার, পাকস্থলী, ইসোফেগাল বা অ্যাডেনোকার্সিনোমা, অগ্নাশয়ের ক্যানসার, এন্ডোমেট্রিয়াম সহ প্রায় ১২ রকমের ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায় স্থূলত্ব। দেখা গেছে, মধ্যবয়স্ক কোভিড রোগীদের অর্ধেকই স্থূলত্বের শিকার।
স্থূলত্বের কারণে শরীরে নানা রোগ বাসা বাঁধে। হার্টের ক্ষমতা কমে, ফুসফুসের কার্যকারীতা কমে। ফ্যাটি লিভার, লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হন অনেক রোগীই। অধিক স্থূলত্ব থেকে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, লিভার, খাদ্যনালীর রোগ এমনকি হরমোন ক্ষরণেরও তারতম্য দেখা দেয়। শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এমনিতেই কম থাকে। তাই ভাইরাস এমন শরীরের সংস্পর্শে এলে খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ওবেসিটি কমাতে নজর দিন ডায়েটে
যে খাবারই খান, তা যেন প্রাকৃতিক ভাবে উৎপন্ন হয়। সোজা কথায় বললে, প্যাকেটজাত বা প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চেষ্টা করুন পাতে টাটকা ও প্রাকৃতিক খাবার রাখতে। প্রক্রিয়াজাত খাবারে অতিরিক্ত চিনি ও লুকনো ট্রান্স ফ্যাট মেদ জমায়। আজকাল প্যাকেটজাত প্রসেসড মিট খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। প্রসেসড মিট বেশি খেলে পাকস্থলিতে কিছু ক্ষতিকারক ব্যাকটিরিয়া দ্রুত গতিতে বাড়তে শুরু করে৷ যা মাংসের কারনিটিন নামের উপাদান ভেঙে গিয়ে ট্রাইমিথাইল্যামিন যৌগে পরিণত হয়। রক্তে শোষিত হয়ে, লিভারের বিপাক ক্রিয়ায় ভেঙে ট্রাইমিথাইল্যামিন-এন-অক্সাইডে পরিণত হয় যা হার্টের সূক্ষ্ম রক্তনালিতে চর্বি জমিয়ে ইসকিমিক হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। সব রকম খাবারই রাখতে হবে খাদ্যতালিকায়। তাতে যেমন প্রোটিন থাকবে, তেমনই ফ্যাট ও শর্করাও। সবই রাখতে হবে পরিমাণ মতো। সে ক্ষেত্রে ফ্যাট নিতে হবে প্রয়োজনীয় মাছ-মাংস বা রান্নায় যেটুকু তেল লাগছে তা থেকেই। বাড়তি ফ্যাটযুক্ত খাবার তালিকায় না রাখাই ভাল।
আসলে এটা খাব না, ওটা খাব না শুনতে যেমন ভাল লাগে, কাজের বেলায় তা খুব একটা হয় না। ভাজাভুজি, নরম পানীয়, আইসক্রিম, চকোলেট দেখলেই মন ছোঁকছোঁক করে। আসলে মেদ ঝরাতে গেলে যে সব খাবারে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিতে হবে তেমনটা নয়। পরিমান মতো মেপে খেলেই কোনও অসুবিধা নেই। তবে এই পরিমাণের মাপকাঠি সবার কাছে এক রকম নয়। গণ্ডগোলটা তৈরি হয় সেখানেই। নিয়মিত শরীরচর্চা করলে যে কোনও খাবারই খাওয়া যায়, তবে হ্যাঁ কিছু খাবারে লাগাম টানতে হবে অবশ্যই। শুধুমাত্র রোগা হওয়ার জন্য নয়, শরীর ঠিক রাখার জন্যও বটে।
সফট ড্রিঙ্কসে ছোঁকছোঁক করলেই বিপদ
ওবেসিটি থেকে বাঁচতে নরম পানীয়ে লাগাম টেনেছেন অনেকেই, তবে প্রাণে ধরে ছেড়ে দিতে পারেননি। অনেকে আবার কৌশল করে ডায়েট পানীয় বেছে নিয়েছেন। বিপদ কিন্তু সবেতেই। মেদবৃদ্ধি শুধু নয়, নরম পানীয় হার্টের রোগের ঝুঁকি ৪৮ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। ডায়েট পানীয়ে ক্যালরির পরিমাণ কম থাকে ঠিকই, কিন্তু অ্যাডেড সুগার শরীরে ক্ষতি করে। ডায়েট পানীয়কে সংরক্ষণের জন্য প্রিজারভেটিভ যোগ করা হয়, যার থেকে অ্যালঝাইমার্সের মতো অসুখ হানা দিতে পারে।
কচমচ করে ভাজাভুজি নৈব নৈব চ
সন্ধের আড্ডায় বা অফিসের বিরতিতে একগাদা চিপস, কুরমুরে কচরমচর করে খেয়ে আত্মার তৃপ্তি হয় বটে, কিন্তু শরীর প্রতিবাদ করে। বাঙালির ভূরিভোজ মানেই নানারকম ভাজাভুজি। এখন তো আবার ফ্রেঞ্চ ফ্রাইও বাঙালি কুইসিনে জায়গা করে নিয়েছে। ভাজাভুজি মানেই তেল চপচপে খাবার ঢুকছে শরীরে। চড়চড় করে বাড়ছে টক্সিন। ট্রান্স ফ্যাট মেদ বাড়াচ্ছে। পেটে-কোমরে অবাঞ্চিত মেদের কারণই হল যখন তখন ভাজাভুজি খেয়ে খিদে মেটানোর প্রবণতা। প্রচণ্ড খিদের মুখে হাই ক্যালোরি ভাজা বা প্রসেসড ফুডের আসক্তি বাড়ে৷ ভাজাভুজি না খেয়ে মন শক্ত করে ডায়েটে রাখুন পুষ্টিকর খাবার। খাবারের মোট ক্যালোরির ২৫ শতাংশ প্রোটিন থেকে এলে ভুলভাল খাবার খাওয়ার প্রবণতা কমে যায়। শাকসবজি, ফল, ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার রাখুন রোজকার ডায়েটে।
মিষ্টি থাক শেষ পাতে, তবে মেপেজুপে
বাঙালিকে মিষ্টি খেতে বারণ করা অপরাধেরই সামিল। মিষ্টি ভাল, তবে মেপেঝুপে খাওয়া আরও ভাল। ভাজা মিষ্টি, একগাদা ক্ষীর, মালাই দেওয়া গাওয়া ঘিয়ে ভাজা মিষ্টি যদি রোজকার ডায়েটে থাকে তাহলে শুধু মেদই বাড়বে না, আরও উটকো রোগ এসে জুটবে শরীরে। তবে মিষ্টি বলতে যে শুধু ছানার মিষ্টির কথা বলা হচ্ছে তা নয়, কুকিস, চকোলেট, আইসক্রিম বা যে কোনও বেকড আইটেমও রয়েছে এই তালিকায়। চকোলেটের একটা আস্ত বার খেয়ে ফেললে একবারে ২০০-৩০০ ক্যালোরি ঢুকে যায় শরীরে। তাই চকোলেট প্রেমীদের জন্য এটা বিশেষ সতর্কবার্তা। চকোলেট থাক, তবে একগাদা দুধ-মাখনের নয়, ফ্রিজে উঠুক ডার্ক চকোলেট। আসলে চকোলেটে প্রচুর চিনি ও ফ্যাট বাড়ানোর উপাদান থাকে, তাই ডাক্তাররা একটু মানা করেন। কিন্তু ডার্ক চকোলেটে এত ঝামেলা নেই। শরীরের জন্যও কার্যকর। ডার্ক চকোলেট যেমন শরীরে ফ্রি র্যাডিকালসের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে তেমনি এর অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট রোগ প্রতিরোধেও সাহায্য করে। আবার মানসিক অবসাদ, স্ট্রেস কমাতেও ডার্ক চকোলেটের বিশেষ ভূমিকা আছে।
ওজন কমাতে কতটা ভরসা রাখা যায় ভাতে
সেডেন্টারি লাইফস্টাইলে ‘লো ফ্যাট নো কার্বস’ ডায়েট উপযোগী হলেও, ঠিকমতো মেনে চলতে না পারলে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই কার্বোহাইড্রেটকে পুরোপুরি বর্জন না করেও সুস্থ ও সুন্দর স্বাস্থ্য পেতে নিয়ম মতো খাওয়াই ভালো। দুপুরে বাঙালির পাতে দু’মুঠো ভাতের কোনও বিকল্প হয় না। রাতে রুটি চলতেই পারে। আবার দুপুরে রুটিতে অভ্যস্ত হলে, রাতে অল্প পরিমাণ ভাতে কোনও অসুবিধা নেই। ভাতে ফাইবার নেই বললেই চলে। যদি ভাতের পরিমাণ কমিয়ে তার সঙ্গে ফাইবারসমৃদ্ধ আনাজপাতি যোগ করা যায়, তা হলে রোজই ভাত খাওয়া যায়।
ভাতের পরিমাণ এক বারে এক থালা হওয়া উচিত নয়। কে রোজ কতটা পরিমাণে ভাত খাবেন, তা নির্ভর করে সেই মানুষটির উচ্চতা এবং ওজনের উপরে। এক জন সম্পূর্ণ সুস্থ এবং আদর্শ উচ্চতা ও ওজনসম্পন্ন মানুষের ডায়েটে সাধারণত ৫৫-৬০ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট থাকতে পারে। সেই কার্বোহাইড্রেট মানে কিন্তু পুরোটাই ভাত নয়। তার মধ্যে বিস্কিট, ফলের কার্বোহাইড্রেটও পড়ে। সুতরাং দিনে একবার অল্প পরিমাণ ভাত মোটেও ক্ষতিকর নয়। ইদানীং গ্লুটেনের সমস্যায় ভোগেন বহু মানুষ। গ্লুটেন অ্যালার্জি এড়াতে চাইলে ভাতের চেয়ে উপকারী আর কিছু নেই। ভাতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি, যা শরীরের কোষ সুস্থ রাখে। ভাত আবার অ্যামিনো অ্যাসিডে ভরপুর। শরীরের কার্যক্ষমতা বাড়ানোর জন্য অ্যামিনো অ্যাসিড খুব জরুরি।
প্রসেসড মিট নয়, মাছ খান
রেড মিট বা প্রসেসড মিটের বদলে ভরসা থাক লিন মিটে। প্রায় সব ধরনের হোয়াইট মিট পড়ে লিন মিটের পর্যায়ে। এর মধ্যে রয়েছে পোলট্রি ও মাছও। চিকেন ছাড়াও লিন প্রোটিনের অন্যতম উৎস মাছ। প্রোটিনের পাশাপাশি মাছে রয়েছে ভিটামিন ডি ও ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড যা মস্তিষ্ককে তরতাজা রাখতে সাহায্য করে। লিন মিটে কোলেস্টেরল ও স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণও অনেক কম।
তবে একগাদা তেল-মশলা দিয়ে কালিয়া খাওয়ার ঝোঁক কমিয়ে বরং হাল্কা মাছের ঝোলেই মন ভরুক। তাতে পেটও ভাল থাকবে আর হার্টও। সি-ফুড পছন্দ হলে চিংড়ি, কাঁকড়া, স্কুইড খাওয়া যেতেই পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, সামুদ্রিক মাছের মধ্যে থাকে প্রচুর পরিমাণ ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড। এই উপাদান রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইড বা ফ্যাটের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। মস্তিষ্ককেও সজীব রাখে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড। মস্তিষ্কে সিরোটোনিন, ডোপামাইন হরমোনের ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে। তাই মাছ খেলে মানসিক স্বাস্থ্যও ভাল থাকে। অবসাদের ঝুঁকি কমে।